Tuesday 4 April 2017

আল্লাহর দিকে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এর দাওয়াতের বাস্তব কিছু নমুনা


আল্লাহর দিকে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এর দাওয়াতের বাস্তব কিছু নমুনা



ভূমিকা
আল্লাহ তা‘আলা প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) কে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন, মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান ও তার প্রতি দাওয়াত দেয়ার জন্য। নবী হিসেবে তিনিই হলেন, সর্বশেষ নবী; তারপর আর কোন নবী দুনিয়াতে আসবে না। কিন্তু আল্লাহর দিকে আহ্বান করার জন্য একদল দা‘ঈ বা নবীদের উত্তরসূরি কিয়ামত পর্যন্ত দুনিয়াতে অবশিষ্ট থাকবে, যারা মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকবে এবং
নবী-রাসূলদের শূন্যতা পূরণ করবে। একজন দা‘ঈর জন্য তার দাওয়াতি ময়দানে রাসূল (ﷺ) এর আদর্শকে আঁকড়ে ধরা এবং সর্ব ক্ষেত্রে রাসূল (ﷺ) এর আদর্শকে সমুন্নত রাখার কোন বিকল্প নাই। রাসূল (ﷺ) মানুষকে দাওয়াত দিতে গিয়ে যখন যেভাবে যে হিকমত ও কৌশল অবলম্বন করেন একজন দা‘ঈর জন্য তার দাওয়াতের ময়দানে তাই হল গুরুত্বপূর্ণ পাথেয় ও অনুকরণীয় আদর্শ। রাসূল (ﷺ) মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের হিকমত, কৌশল ও বুদ্ধি গ্রহণ করেন। রাসূল (ﷺ) দাওয়াতের ক্ষেত্রে যে সব হিকমত ও কৌশল অবলম্বন করেন এ যে উন্নত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন, তা যদি একজন দা‘ঈ তার কর্মক্ষেত্রে ও দাওয়াতি ময়দানে অবলম্বন করে, তাহলে সে অবশ্যই সফল হবে। এছাড়া যদি সে রাসূল (ﷺ) আদর্শ সমূহে গভীরভাবে চিন্তা করে, তাহলে দাওয়াতের ক্ষেত্রে তার সফলতা অর্জন নিশ্চিত। হিকমত ও বুদ্ধিমত্তার সাথে দাওয়াতি কাজকে সম্পন্ন করতে তার থেকে আর কোন ত্রুটি হবে না। দাওয়াতি ময়দানে রাসূল (ﷺ) এর জীবনী থেকে সংগৃহীত হিকমত, বুদ্ধি ও কৌশলগুলো সে কাজে লাগাতে পারবে।


সুতরাং, একটি কথা মনে রাখতে হবে, রাসূল (ﷺ) ই হল, একজন মুসলিমের জন্য পরিপূর্ণ আদর্শ। তার আদর্শের অনুকরণই হল, একজন প্রকৃত দা‘ঈর মৌলিক কাজ। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে করীমে এরশাদ করেন,
﴿لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَة لِّمَن كَانَ يَرۡجُواْ ٱللَّهَ وَٱلۡيَوۡمَ ٱلۡأٓخِرَ وَذَكَرَ ٱللَّهَ كَثِير ا﴾ [الأحزاب: 21]
অর্থ, অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ, তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।সূরা আহযাব; আয়াত: ২১

আমি আমার এ পুস্তিকাটিতে রাসূল (ﷺ) ইসলামের দাওয়াত দিতে গিয়ে যে সব হিকমত, বুদ্ধি ও কৌশল অবলম্বন করেন, তার একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে চেষ্টা করব। একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, রাসূল (ﷺ) তার জীবনে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিতে গিয়ে অসংখ্য ও অগণিত হিকমত ও কৌশল অবলম্বন করেছেন; যাতে মানুষ ঈমানের উপর উঠে আসে। এ গুলো সবকে একত্র করা কারো দ্বারাই সম্ভব না। তবে আমি এ পুস্তিকাটিতে রাসূল (ﷺ) এর জীবনী হতে দৃষ্টান্ত স্বরূপ কিছু আলোচনা করার প্রয়াস চালাব; যাতে একজন দা‘ঈ কিছুটা হলে অনুমান করতে পারে । আমি আমার এ রিসালাটিকে দুটি অধ্যায়ে ভাগ করছি।

প্রথম অধ্যায়: হিজরতের পূর্বে দাওয়াতি ময়দানে রাসূল (ﷺ) এর অবস্থান।
দ্বিতীয় অধ্যায়: হিজরতের পরে রাসূল (ﷺ) এর অবস্থান।

প্রথম অধ্যায়:
হিজরতের পূর্বে রাসূল (ﷺ) দাওয়াতি কার্যক্রম
প্রথম অধ্যায়কে কয়েকটি পরিচ্ছেদে ভাগ করা হয়েছে।

প্রথম পরিচ্ছেদ:
গোপনে দাওয়াত দেওয়ার সময়ে রাসূল (ﷺ) এর দাওয়াতি কার্যক্রম:
এ কথা অজানা নয় যে, মক্কা ছিল, আরবদের ধর্ম পালনের প্রাণ কেন্দ্র ও উপযোগী ভূমি। এখানে ছিল আল্লাহর পবিত্র ঘর কাবার অবস্থান। আরবের সমগ্র মূর্তিপূজক ও পৌত্তলিকদের আবাসভূমি ও যাবতীয় কর্মের ঘাটিও ছিল, এ মক্কা নগরী। এ কথা আমাদের সবারই মনে রাখতে হবে, পাহাড় আর মরুভূমিতে ঘেরা পবিত্র এ মক্কা নগরীতে আল্লাহর দিকে মানুষকে দাওয়াত দেয়ার মিশনটিকে তার মনজিলে মকসুদে পৌঁছানো, ততটা সহজ ছিল না। বরং বলতে গেলে এটা ছিল অনেকটাই দুর্বোধ্য ও দু:সাধ্য। একজন সাধারণ মানবের দ্বারা এ অসাধ্য কাজকে সাধ্য করা এবং সফলতায় পৌঁছানো কোন ক্রমেই সম্ভব ছিল না। যদি দাওয়াতের জন্য নির্বাচিত ভূমি মক্কা না হয়ে অন্য কোন ভূমি হত, বা তা মক্কা থেকে অনেক দূরে হত, তাহলে এতটা কষ্টকর হয়তো হত না। এ কারণেই বলা বাহুল্য, এ অনুপযোগী ও অনুর্বর ভূমিতে দাওয়াতি কাজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন ছিল, এমন একজন মহা মানবের, যার দৃঢ়ত, আত্মপ্রত্যয় ও অবিচলতা হবে বিশ্বসেরা; যাতে কোন ধরনের বিপদ-আপদ ও মুসিবত তাকে ও তার দাওয়াতের মিশনটিকে কোন-রকম দুর্বল করতে না পারে। আরও প্রয়োজন ছিল, এমন সব হিকমত ও কৌশল অবলম্বন করা, যেসব বুদ্ধিমত্তা, হিকমত ও কৌশল দিয়ে, সে তার বিরুদ্ধে গৃহীত যাবতীয় ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে পারে এবং সব ধরনের বাধা বিঘ্ন দূর করে দাওয়াতের মিশনটিকে সফলতার ধার প্রান্তে পৌছাতে পারে। নি:সন্দেহে বলা যায়, অনুগ্রহ ও দয়া মহান আল্লাহরই যিনি হলেন, আহাকামুল হাকেমীন; তিনি যাকে চান হিকমত দান করেন, যাকে চান না তাকে হিকমত দান করেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يُؤۡتِي ٱلۡحِكۡمَةَ مَن يَشَآءُۚ وَمَن يُؤۡتَ ٱلۡحِكۡمَةَ فَقَدۡ أُوتِيَ خَيۡر ا كَثِير اۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّآ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ﴾ [البقرة: 269]
অর্থ, তিনি যাকে চান প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে প্রজ্ঞা দেয়া হয়, তাকে অনেক কল্যাণ দেয়া হয়। আর বিবেক সম্পন্নগণই উপদেশ গ্রহণ করে।সূরা বাকারা আয়াত: ২৬৯

আল্লাহ তাআলা মুহাম্মদ (ﷺ) কে রিস্বলাতের দায়িত্ব দেয়ার মাধ্যমে হিকমত ও জ্ঞান দান করেছেন, ভালো কাজের তাওফিক দিয়েছেন এবং আল্লাহ তাকে তার যাবতীয় কর্মে সাহায্য করেছেন।

এ কারণে, আল্লাহর পক্ষ হতে যখন তার স্বজাতিদের ইসলামের দাওয়াত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়, তখন তিনি তাদের দাওয়াত দেয়ার জন্য বিভিন্ন কৌশল ও হিকমত অবলম্বন করেন। তিন প্রথমেই সবাইকে ডেকে একত্র করে ইসলামের দাওয়াত দেয়া শুরু করেননি। প্রথমে দু একজনকে গোপনে গোপনে ইসলামের দাওয়াত দিতে আরম্ভ করেন; তারা যে সব শিরক, কুফর ও ফিতনা-ফ্যাসাদে নিমগ্ন, তার পরিণতি সম্পর্কে তাদের সতর্ক ও ভয় পদর্শন করেন। শুরুতেই তাদের যাবতীয় অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা আরম্ভ করেননি বরং প্রথমে তিনি তাদের তাওয়াহ্‌য়ীদের দাওয়াত দেয়া আরম্ভ করেন। তাওয়াহ্‌য়ীদের দিকে দাওয়াত দেয়ার মাধ্যমেই তিনি তার মিশনটি আরম্ভ করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلۡمُدَّثِّرُ ١ قُمۡ فَأَنذِرۡ ٢ وَرَبَّكَ فَكَبِّرۡ ٣ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرۡ ٤ وَٱلرُّجۡزَ فَٱهۡجُرۡ ٥ وَلَا تَمۡنُن تَسۡتَكۡثِرُ ٦ وَلِرَبِّكَ فَٱصۡبِرۡ ٧﴾ [المدثر: 1-7]
হে বস্ত্রাবৃত! উঠ অত:পর সতর্ক কর। আর তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। আর তোমার পোশাক-পরিচ্ছদ পবিত্র কর। আর অপবিত্রতা বর্জন কর। আর অধিক পাওয়ার আশায় দান করো না। আর তোমার রবের জন্যই ধৈর্যধারণ কর।সূরা মুদ্দাচ্ছের আয়াত: ১-৭

এখান থেকে রাসূল (ﷺ) কুরাইশদের পক্ষ থেকে যে নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, তার সমাধানের লক্ষে হিকমত ও কৌশলের পথ চলা আরম্ভ করেন। তিনি এমন এক বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানের পরিচয় দেন, যা এ যাবত-কাল পর্যন্ত দুনিয়াতে যত বড় বড় জ্ঞানীদের আবির্ভাব হয়েছে, তাদের সকলের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তাকে হার মানিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, বরং সমগ্র মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি এ যায়গায় এসে অক্ষম হয়ে যায়। রাসূল (ﷺ) প্রথমে তার সবচেয়ে কাছের লোক ও আত্মীয় স্বজনদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। পরিবার- পরিজন, বন্ধু-বান্ধব এবং যাদের তিনি ভালো বলে জানতেন এবং তারাও তাকে ভালো জানত, তাদের দিয়েই তিনি তার দাওয়াতের কাজ শুরু করেন। এছাড়াও যাদের মধ্যে সততা, ন্যায়-পরায়ণতা, কল্যাণ ও সংশোধন হওয়ার মত যোগ্যতা ও গুণাগুণ লক্ষ্য করতেন, তাদের তিনি তার দাওয়াতের আওতায় নিয়ে আসতেন এবং তাদের ইসলামের দাওয়াত দিতেন। এভাবে অত্যন্ত সংগোপনে ও অত্যধিক বুদ্ধিমত্তা ও সাবধানতার সাথে তিনি দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। তার প্রাণপণ চেষ্টার ফসল হিসেবে দেখা গেল, অতি অল্প সময়ে তাদের মধ্য হতে একটি ক্ষুদ্র জামাত ইসলামের ডাকে সাড়া দিল এবং তারা ইসলাম গ্রহণ করল। ইসলামের ইতিহাসে এদের সাবেকীনে আওয়ালীন বলা হয়ে থাকে। নারীদের মধ্যে সর্ব প্রথম রাসূল (ﷺ) এর স্ত্রী খাদিজা বিনতে খুয়াইলদ (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন। আর পুরুষদের মধ্যে আলী ইবনে আবু তালিব (রাঃ) তারপর তার গোলাম যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ) তারপর আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) প্রমুখ ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হন। আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) নিজে ইসলাম গ্রহণ করার পর, নিজ উদ্যোগে আরও কতককে ইসলামের দাওয়াত দেন, তার দাওয়াতের ফলে এমন কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করে, যাদের অবদান ও ভূমিকা ইসলামের ইতিহাসে কিয়ামত অবধি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে এবং তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আর এসব মহা মনীষীরা হল, ওসমান ইবনে আফ্ফান (রাঃ) যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রাঃ) আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) সায়াদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) ও তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ। এরা সবাই আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করে। আলী (রাঃ), যায়েদ ইবনে হারেসা ও আবু বকর (রাঃ) সহ মোট আটজন ছাহাবী, যারা হলেন ইসলামের অগ্রপথিক ও প্রথম অতন্দ্র প্রহরী। এরা তারাই যারা সমস্ত মানুষের পূর্বে ইসলামের সুশীতল পতাকা তলে সমবেত হয়। সারা দুনিয়ার সমগ্র মানুষের বিরোধিতা স্বত্বেও তার কোন প্রকার পরোয়া না করে আল্লাহর নবীর আনিত দ্বীনের দাওয়াতে সাড়া দেন। তাদের ইসলাম গ্রহণের পর আরব জাহানে ঈমানের আলোড়ন সৃষ্টি হয়, এক এক করে মানুষ ইসলামে প্রবেশ করতে আরম্ভ করে এবং ঈমানের পতাকা তলে তারা সমবেত হতে থাকে। রাসূল ও তার সঙ্গীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও বিরামহীন দাওয়াতের ফলে ধীরে ধীরে মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল এবং মক্কায় ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ল। সমগ্র মক্কায় রাসূল (ﷺ) এর ইসলামের দিকে দাওয়াত দেয়া ও আল্লাহর তাওয়াহ্‌য়ীদের বিষয়টি তাদের আলোচনার প্রথম শিরোনামে পরিণত হল। একমাত্র দাওয়াতের আলোচনা ছাড়া আর কোন আলোচনা তাদের মধ্যে স্থান পেল না। এভাবেই দাওয়াতের প্রসার ঘটে এবং মুসলিমদের সংখ্যা দিন দিন আরও বাড়তে থাকে। যারা ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হয়, রাসূল (ﷺ) তাদের নিয়ে গোপনে বৈঠক করতেন, গোপনে তাদের তালীম- তরবিয়ত ও গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা দিতেন; যাতে তারা আল্লাহর দ্বীনের মহান গুরু দায়িত্ব পালনে সক্ষম একটি জামাতে পরিণত হয় এবং কোন প্রকার জুলুম নির্যাতন তাদের মনোবলকে দুর্বল করতে না পারে।

মোট কথা, দাওয়াতের কাজটি ছিল তখনো ব্যক্তি পর্যায়ে ও গোপনে; প্রকাশ্যে দাওয়াত দেয়ার পরিবেশ তখনো তৈরি হয়নি। রাসূল (ﷺ) কুরাইশদের মাঝে এখনো প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে আরম্ভ করেননি। তিনি তার দাওয়াতের কাজটি গোপনে চালিয়ে যেতেন এবং যারা ইসলাম গ্রহণ করে তারা তাদের ইবাদত বন্দেগী ও ইসলামের বিধানাবলী গোপনে পালন করত। ইসলামের প্রথম যুগে কুরাইশদের ভয়ে মুসলিমরা ইসলামকে প্রকাশ করা ও প্রকাশ্যে ইবাদত বন্দেগী করার সাহস পেত না; ফলে তারা গোপনে ইবাদত বন্দেগী করত। সীরাতে ইবনে হিশাম: ২৬৪/১, ইমাম শামছুদ্দিন আয-যাহবী রহ. এর তারিখুল ইসলাম সীরাত অধ্যায়: পৃ: ১২৭, বিদায়া নিহায়া: ২৪-৩৭, যাদুল মাআদ: ১৯/৩, মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব রহ. এর মুখতাছার সীরাত: পৃষ্ঠা ৫৯, মাহমুদ শাকের রহ. এর তারিখে ইসলামী: ৫৭/২, এবং হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব: পৃ:৯১

এ ভাবে দাওয়াতের কাজ চলতে থাকলে ধীরে ধীরে মুসলিমদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেতে লাগল এবং ক্রমপর্যায়ে মুসলিমদের সংখ্যা চল্লিশে উন্নীত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাসূল (ﷺ) কুরাইশদের মাঝে প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে আরম্ভ করেননি। তিনি গোপনেই তাদের দাওয়াত দিতে থাকেন। কারণ, বিজ্ঞ রাসূল (ﷺ) এ কথা ভালো ভাবেই জানতেন, মুসলিমদের এ ক্ষুদ্র জামাত কুরাইশদের তুলনায় এখনো নগণ্য। এ ক্ষুদ্র জামাতকে কুরাইশদের পক্ষ থেকে যে সব বাধা-বিপত্তি, জুলম নির্যাতন ও প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হবে, তা প্রতিহত করা সম্ভব হবে না।

রাসূল (ﷺ) তার দাওয়াতে সাড়া দেয়া মুসলিমদের নিয়ে তাদের দিক নির্দেশনা ও তালীম দেয়ার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেন। এ জন্য তিনি তাদের নিয়ে একত্রে এক জায়গায় বসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন; যাতে তাওয়াহ্‌য়ীদের ডাকে সাড়া দানকারী ঈমানদারদের মধ্যে পারস্পরিক সু-সম্পর্ক তৈরি হয় এবং তাদের মাধ্যমে আরও যারা তাওয়াহ্‌য়ীদের বাহিরে আছে, তাদের নিকট তাওয়াহ্‌য়ীদের দাওয়াত পৌঁছে যায়। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে রাসূল (ﷺ) একটি নিরাপদ স্থান খুঁজতে থাকেন। সর্বশেষ তিনি এর জন্য সৌভাগ্যবান সাহাবী আবী আরকাম আল মাখযুমীর ঘরকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করেন। রাসূল (ﷺ) এখানে মুসলিমদের একই পরিবারের সদস্যদের মত করে একত্র করেন এবং এ ঘরের মধ্যে বসেই তিনি তাদের দ্বীন শেখান, তালীম-তরবিয়ত দেন এবং জীবন যাপনের যাবতীয় দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। আপাতত এ ঘরকেই রাসূল (ﷺ) ইসলামের প্রধান কার্যালয় হিসেবে নির্ধারণ করেন। তবে এর পাশাপাশি আরও কিছু শাখা কার্যালয় ছিল, যে গুলোতে রাসূল (ﷺ) মাঝে মাঝে গিয়ে সমবেত লোকদের তালীম দিতেন অথবা রাসূল (ﷺ) যার ঘরকে পছন্দ করতেন, সেখানে গিয়ে লোকজনদের একত্র করে তাদের তালীম দিতেন। রাসূল (ﷺ) আরও যাদের ঘরকে পছন্দ করেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হল, সাঈদ ইবনে যায়েদ (রাঃ)। তবে দাওয়াতের শুরু লগ্নে যখন মুসলিমরা দুর্বল ও সংখ্যালঘু ছিল; তারা তাদের ঈমান প্রকাশ করার কোন ক্ষমতা রাখত না এবং গোপনে গোপনে তারা ইবাদত বন্দেগী করত এবং মানুষদের ইসলামের দিকে আহ্বান করতেন; তখন দারে আরকামই ছিল ইসলাম ও মুসলিমদের প্রথম প্রাণ কেন্দ্র ও সুদৃঢ় দুর্গ। এখান থেকে ইসলামের দাওয়াত পরিচালিত হত। একটি কথা মনে রাখতে হবে, তখন ইসলামের দাওয়াত ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছিল। আল- বিদায়া ওয়ান-নিহায়া: ৩১/৩, মাহমুদ শাকের রহ. এর তারিখে ইসলামী ৬২/২, এবং হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব: পৃ: ৯৭।

এভাবে তিন বছর পর্যন্ত ইসলামের দাওয়াত অত্যন্ত সংগোপন ও ব্যক্তি পর্যায়ে একেবারেই সীমিত আকারে চলছিল। ইসলামের দাওয়াতকে প্রকাশ করার কোন সুযোগ মুসলিমদের ছিল না। লোক চক্ষুর অন্তরালে ও অতি সংগোপনে পরিচালিত দাওয়াতের কাজ ধীরে ধীরে গতি-লাভ করে এবং মুসলিমরা একটা জামাতে পরিণত হয়। ইসলামের মত নেয়ামতের ফলে মুসলিমরা পরস্পর ভাই ভাই পরিণত হয়, তারা একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে এবং তারা একে অপরকে ইসলামের সুশীতল ছায়া তলে সমবেত হওয়ার দাওয়াত দেয়।

তারপর রাসূল (ﷺ) এর চাচা হামযা ইবনে আব্দুল মুত্তালিবা (রাঃ) ও আরও কতক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ যেমন, ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করে। তাদের ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলিম জামাত অনেকটা শক্তিশালী হয় এবং তাদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হয়। তারপর আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন,
﴿فَٱصۡدَعۡ بِمَا تُؤۡمَرُ وَأَعۡرِضۡ عَنِ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ٩٤ إِنَّا كَفَيۡنَٰكَ ٱلۡمُسۡتَهۡزِءِينَ ٩٥ ٱلَّذِينَ يَجۡعَلُونَ مَعَ ٱللَّهِ إِلَٰهًا ءَاخَرَۚ فَسَوۡفَ يَعۡلَمُونَ ٩٦﴾ [الحجر: 94- 96]
অর্থ, যে আদেশ দেয়া হয়েছে, তা ব্যাপকভাবে প্রচার কর এবং মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও। নিশ্চয় আমি তোমার জন্য উপহাসকারীদেরে বিপক্ষে যথেষ্ট। যারা আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহ নির্ধারণ করে। অতএব তারা অচিরেই জানতে পারবে। সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৯৪-৯৬।

এতে এ কথা স্পষ্ট হয়, আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে প্রজ্ঞা ও হিকমতে পরিপূর্ণতা দান করেই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন।

রাসূল (ﷺ) দাওয়াতের ক্ষেত্রে যে উন্নত পদ্ধতি, হিকমত ও অভিজ্ঞতার সাক্ষর রাখেন, আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী একজন দা‘ঈর জন্য তা কিয়ামত পর্যন্ত অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে। আর যে আহ্বানকারী রাসূল (ﷺ) এর দাওয়াতের পদ্ধতি ও হিকমত অবলম্বন করবে প্রকৃত পক্ষে সেই আল্লাহর রাসূলের অনুসৃত পথের অনুকরণকারী বলে গণ্য হবে। বিশেষ করে পৌত্তলিক কাফেরদের দাওয়াতের ক্ষেত্রে রাসূল (ﷺ) এর আদর্শের বাইরে যাওয়ার কোন অবকাশ নাই। কারণ, এ ক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই রাসূল (ﷺ) এর উন্নত আদর্শ ও হিকমতের অনুকরণ করতে হবে। তবে বর্তমানে কোন মুসলিম দেশে ইসলামের দাওয়াতকে গোপনে দেয়ার কোন অবকাশ নাই। কারণ, এখন ইসলামের দাওয়াত সারা দুনিয়ার আনাচে কানাচে পৌঁছে গেছে; ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেনি এমন দুর্গম এলাকা বর্তমান দুনিয়াতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। রাসূল (ﷺ) তার প্রথম যুগে গোপনে দাওয়াত দেন; কারণ, তখন ইসলামের দাওয়াত ছিল অংকুর সমতুল্য। যারা ইসলাম গ্রহণ করে তারা তাদের ইসলাম প্রকাশ করার মত কোন পরিবেশ ছিল না। অবস্থা এমন ছিল যে, ইসলামের প্রথম যুগে রাসূল ও তার সাথী-সঙ্গীরা প্রকাশ্যে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই) কথাটি বলতে পারত না, প্রকাশ্যে আযান দিতে ও স্বলাত আদায় করতে পারত না। তারপর যখন মুসলিমদের শক্তি, সামর্থ্য ও সাহস বৃদ্ধি পেল, আল্লাহ তা‘আলা তার রাসূলকে প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার আদেশ দেন। চেল্লাহর আদেশ পেয়ে রাসূল (ﷺ) প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে আরম্ভ করেন। রাসূল (ﷺ) এর আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে মুসলিমদের সংখ্যা আরও বাড়তে থাকে। কিন্তু মুসলিমদের বৃদ্ধি পাওয়া কাফেরদের ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়াল। কাফেররা মুসলিমদের কোনক্রমেই সহ্য করতে পারল না। তাই কাফেরদের পক্ষ হতে মুসলিমদের এমন নির্মম ও অমানবিক অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হল, যার ইতিহাস আমাদের কারো অজানা নয়। রাহীকুল মাখতুম: পৃ: ৭৫, মাহমুদ শাকের রহ. এর তারিখে ইসলামী: ৬২/২ এবং হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব: পৃ: ৯৯।

দ্বিতীয় পরিচ্ছদ:
মক্কায় প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত:
প্রথমে আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে নিকটাত্মীয়দের ইসলামের দাওয়াত দিতে নির্দেশ দেন। নিকটাত্মীয়দের মধ্যে প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেয়া আরম্ভ করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَأَنذِرۡ عَشِيرَتَكَ ٱلۡأَقۡرَبِينَ ٢١٤ وَٱخۡفِضۡ جَنَاحَكَ لِمَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٢١٥ فَإِنۡ عَصَوۡكَ فَقُلۡ إِنِّي بَرِيٓء مِّمَّا تَعۡمَلُونَ﴾ [الشعراء:214-216]
আর তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক কর। আর মুমিনদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করে, তাদের প্রতি তুমি তোমার বাহুকে অবনত কর।

তারপর যদি তারা তোমার অবাধ্য হয়, তাহলে বল, তোমরা যা কর, নিশ্চয় আমি তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।সূরা শুয়ারা, আয়াত: ২১৪-২১৬।

আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর রাসূল (ﷺ) মানুষের মধ্যে প্রকাশ্যে দাওয়াত দেয়ার সূচনা করেন। প্রথমে তিনি তার সগোত্রের লোকদের দাওয়াত দিতে আরম্ভ করেন। এ ক্ষেত্রেও তিনি যথেষ্ট প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন, যার ফলে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের মধ্যে দ্রুত ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দেন এবং প্রসার ঘটান। রাসূল (ﷺ) এর সবর, ইখলাস ও সাহসের ফলে তার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা শিরকের মূলো পাটন ঘটায়। কিয়ামত পর্যন্ত মুশরিকদের অপমানিত ও অপদস্থ জাতি হিসেবে চিহ্নিত করেন।
প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে গিয়ে রাসূল (ﷺ) যে সব হিকমত অবলম্বন করেছিলেন তা ছিল নিম্ন রূপ:
 এক:
সাফা পাহাড়ের উপর আরোহণ করে সমগ্র লোকদের একত্র করে আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত দেয়া। এ বিষয়ে হাদিসে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস হতে একটি ঘটনা বর্ণিত,
عن ابن عبا س قال: لما نزلت ﴿وَأَنذِرْ عَشِيرَتَكَ الأَقْرَبِينَ﴾ صعد النبي صلى الله عليه وسلم على الصفا فجعل ينادي: ((يا بني فهر، يا بني عدي)) لبطون قريش حتى اجتمعوا، فجعل الرجل إذا لم يستطع أن يخرج أرسل رسولاً لينظر ما هو، فجاء أبو لهب، وقريش، فقال: ((أرأيتكم لو أخبرتكم أن خيلاً بالوادي تريد أن تغير عليكم، أكنتم مصدقي))؟ قالوا: نعم، ما جربنا عليك إلا صدقاً. قال: ((فإني نذير لكم بين يدي عذاب شديد)). فقال أبو لهب: تبًّا لك سائر اليوم ألهذا جمعتنا؟ فنزلت: ﴿تَبَّتۡ يَدَآ أَبِي لَهَب وَتَبَّ ١ مَآ أَغۡنَىٰ عَنۡهُ مَالُهُۥ وَمَا كَسَبَ﴾ »
অর্থ, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা যখন এ আয়াত নাযিল করেন, রাসূল (ﷺ) সাফা পাহাড়ের উপর আরোহণ করে, প্রতিটি গোত্রের নাম উচ্চারণ করে, তাদেরকে পাহাড়ের পাদদেশে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানান। কুরাইশদের চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী তারা রাসূল (ﷺ) এর ডাকে সাড়া দিল এবং কুরাইশের সমগ্র মানুষ পাহাড়ের পাশে একত্র হয়। রাসূল (ﷺ) এর আহ্বানের পর তাদের মধ্যে মক্কায় তার ডাকে সাড়া দেয়ার একটি হিড়িক পড়ে যায়। এমনকি যদি কোন লোক কোন কারণে উপস্থিত হতে পারেনি, সে তার একজন প্রতিনিধি পাঠাত, যাতে মুহাম্মদ কি বলে, তা তার মাধ্যমে জানতে পারে। রাসূল (ﷺ) এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আবু জাহেল সহ বড় বড় কুরাইশ নেতা ও বিভিন্ন বংশের লোকেরা উপস্থিত হল। রাসূল (ﷺ) সমবেত লোকদের সম্বোধন করে বললেন, আমি যদি তোমাদের খবর দেই যে, এ উপত্যকার অপর প্রান্তে একটি সশস্র সৈন্যদল তোমাদের উপর আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাহলে তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করবে? তারা সবাই এক বাক্যে উত্তর দিল হ্যাঁ! আমরা অবশ্যই তোমাকে বিশ্বাস করব। কারণ, তোমাকে আমরা কখনোই মিথ্যা বলতে দেখিনি। এরপর রাসূল (ﷺ) তাদের বলল, তোমরা মনে রাখ! আমি তোমাদের ভয়াবহ আজাবের পরিণতি সম্পর্কে ভয় দেখাচ্ছি। এ কথা শোনে কমবখত আবু লাহাব সাথে সাথে বলল, তোমার জন্য ধ্বংস! তুমি আমাদের পুরো দিনটি নষ্ট করলে। এ জন্যই তুমি আমাদের ডেকে একত্র করছ ! তার কথার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন। বুখারি কিতাবুত তাফসীর: পরিচ্ছেদ: ﴿ وَأَنذِرۡ عَشِيرَتَكَ ٱلۡأَقۡرَبِينَ ৫০১/৮ হাদীস নং (৪৭৭০) মুসলিম কিতাবুল ঈমান, পরিচ্ছেদ: ﴿ وَأَنذِرۡ عَشِيرَتَكَ ٱلۡأَقۡرَبِينَ ﴾ ১৯৪/১ হাদীস নং (২০৮) আয়াত: ( ১-২ ) সূরা মাসাদ হতে।
অপর একটি বর্ণনায় আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) কুরাইশ বংশের লোকদের একটি একটি করে প্রতিটি গোত্রের লোকদের ডাকেন এবং প্রতিটি গোত্রের লোকদের সম্বোধন করে তিনি বলেন,
((أنقذوا أنفسكم من النار...))، ثم قال: ((يا فاطمة أنقذي نفسك من النار؛ فإني لا أملك لكم من اللَّه شيئاً، غير أن لكم رحماًَ سأبلها ببلاها))
[তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাচাও..] তারপর তিনি তার প্রাণাধিক প্রিয় একমাত্র কন্যা ফাতেমা কে সম্বোধন করে বলেন, [হে ফাতেমা! তুমি তোমাকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাচাও! কারণ, আমি আল্লাহর থেকে তোমাদের কল্যাণে কোন কিছুই করার ক্ষমতা রাখি না। তবে তোমাদের সাথে আমার রয়েছে আত্মীয়তা। আমি তার দ্বারা তোমাদের সাথে কেবল আমার সম্পর্কেই সিক্ত করব।] বুখারি কিতাবুত তাফসীর, পরিচ্ছেদ: ﴿ وَأَنذِرۡ عَشِيرَتَكَ ٱلۡأَقۡرَبِينَ ﴾পৃ: ৫০১/৮ হাদীস নং (৪৭৭০) মুসলিম কিতাবুল ঈমান। পরিচ্ছেদ: ﴿ وَأَنذِرۡ عَشِيرَتَكَ ٱلۡأَقۡرَبِينَ ﴾ ১৯৪/১ হাদীস নং (২০৮) আয়াত: (১-২) সূরা মাসাদ হতে। এ আহ্বান ছিল, দাওয়াতের সর্বচ্চো সোপান। তিনি সমবেত লোকদের সবোর্চ্চ ভয় দেখান এবং সর্বচ্চো সতর্ক করেন। কারণ, তিনি প্রথমে তার একদম কাছের লোকদের এ কথা স্পষ্ট করেন যে, তাদের সাথে সম্পর্কের মানদণ্ড হল, এক আল্লাহর উপর ঈমান আনা ও রিস্বলাতের উপর বিশ্বাস করা। যারা এ দুটি বিষয়ের উপর বিশ্বাস করবে তারাই হল, তার নিকট সবচেয়ে আপন লোক। তিনি আরবদের আরও জানিয়ে দেন যে, জাতিগত, বর্ণগত ও বংশগত যে সব বিবাধ ও বৈষম্য আরবরা দীর্ঘকাল ধরে লালন করে আসছে, আজকের এ আহ্বানের মাধ্যমে তার একটি পরিসমাপ্তি ও ইতি ঘটল। এ সব বিষয় নিয়ে কোন প্রকার বিবাধ বৈষম্য অর্থহীন। এখানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, রাসূল (ﷺ) এ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থেকে সমবেত লোকদের ইসলামের দিকে আহ্বান করেন এবং মূর্তি পূজা হতে তাদের বারণ করেন। যারা তার আহ্বানে সাড়া দেবে তাদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ দেন, আরা যারা তার এ দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করবে তাদের তিনি জাহান্নামের ভয় দেখান।

রাসূল (ﷺ) এর গুরুত্বপূর্ণ দাওয়াতের পর মক্কাবাসী তা সাথে সাথে প্রত্যাখ্যান করে এবং রাসূল (ﷺ) কে শক্ত হাতে মোকাবেলা ও প্রতিহত করার অঙ্গীকার করে। রাসূল (ﷺ) এর দাওয়াত ছিল, তাদের পুরনো অভ্যাস, অন্ধানুকরণ ও জাহিলিয়্যাতের রীতিনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ফলে তারা এ দাওয়াতকে অংকুরে গুটিয়ে দেয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। কিন্তু রাসূল (ﷺ) তাদের বিরোধিতা, গর্জন ও হুংকারে কোন প্রকার কর্ণপাত করেননি, বিচলিত কিংবা দুর্বল হননি। তিনি তার উপর অর্পিত রিস্বলাতের গুরু দায়িত্ব অত্যন্ত সাহসিকতা ও প্রত্যয়ের সাথে চালিয়ে যেতে থাকেন। কারণ, তিনি-তো আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত একজন রাসূল; যদি সারা পৃথিবীও তার বিরোধিতা করে এবং তাকে প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়, তাহলেও আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তা পালন করাই হল তার একমাত্র কাজ। তিনি-তো কোন ক্রমেই তা হতে পিছপা হতে পারেন না। তার উপর যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সারা দুনিয়ার সমগ্র মানুষও যদি একত্র হয়ে তার বিরোধিতা করে, তারপরও তিনি তা থেকে এক চুল পরিমাণও পিছু হটবে না। দেখুন! রাহীকুল মাখতুম: পৃ: ৭৮, ইমাম গাযালী রহ. এর সীরাত গ্রন্থ পৃ: ১০১, মুস্তাফা আস-সাবায়ী রহ. এর সীরাতুন নববী ও শিক্ষনীয় বিষয় পৃ: ৪৭।

রাসূল (ﷺ) প্রকাশ্যে দাওয়াতের ঘোষণা দেয়ার পর থেকে রাত-দিন,- চব্বিশ ঘণ্টা- তিনি মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিতে থাকেন। প্রকাশ্যে ও গোপনে, ব্যক্তি ও সামগ্রিক পর্যায়ে মানুষকে আল্লাহর দিকে বিরামহীনভাবে আহ্বান করতে থাকেন। কোন প্রকার বাধা-বিপত্তি তাকে তার দাওয়াত থেকে ধময়ে কিংবা ফিরিয়ে রাখতে পারেনি। কোন বিরোধিতা-কারীর বিরোধিতা তার দাওয়াতের চলন্ত মিশনের গতিরোধ কিংবা বিঘ্ন ঘটাতে পারেনি। তাকে দাওয়াত হতে বিরত রাখার জন্য কাফেরদের হাজারো চেষ্টা ও কৌশল কোন কাজে আসেনি; তারা তাকে তার মিশন থেকে বিরত রাখতে পারেনি। রাসূল (ﷺ) সব সময় মানুষকে দাওয়াত-আল্লাহর দিকে আহ্বান- করার কাজে লেগেই থাকতেন। তিনি তাদেরকে তাদের কোন মজলিশ হোক বা মাহফিল, সব জায়গায় তাদের দাওয়াত দিতে থাকত। এ ছাড়াও বিভিন্ন মৌসুমে তিনি তাদের আল্লাহর দিকে আহ্বান করতেই থাকেন। বিশেষ করে হজের মৌসুমে যখন লোকেরা বাইতুল্লাহর উদ্দেশ্যে একত্র হত, তখন তিনি এ সময়টাকে দাওয়াতের জন্য গণিমত মনে করতেন। এ সময়ে যার সাথে দেখা হত, তাকেই তিনি আল্লাহর দিকে আহ্বান করতেন; চাই সে গোলাম হোক বা স্বাধীন, ধনী হোক বা গরীব তার নিকট সবাই সমান; কারো প্রতি তিনি কোন প্রকার বৈষম্য প-দর্শন করতেন না। কে দুর্বল আর কে সবল তা তার নিকট বিবেচ্য নয়। তিনি সবাইকে তার দাওয়াতের আওতায় নিয়ে আসতেন এবং আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতেন। একজন দা‘ঈর জন্য এসব গুণাগুণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রাসূল (ﷺ) কে কোনভাবে ক্ষান্ত করতে না পেরে, মক্কার মুশরিকরা ক্ষোভে বিক্ষোভে অগ্নি-শর্মা হয়ে পড়ল। তারা তাদের করনীয় হিসেবে জুলুম নির্যাতনের পথকেই বেচে নিলো। ফলে তারা রাসূল ও তার অনুসারীদের উপর বিভিন্ন ধরনের জুলুম নির্যাতন করতে আরম্ভ করল এবং তাদের বিরুদ্ধে নানাবিধ অপপ্রচার চালানো শুরু করল। কারণ, তারা কোন ক্রমেই আল্লাহর তাওয়াহ্‌য়ীদে বিশ্বাস করা ও মূর্তি পূজাকে ছাড়তে রাজি হল না। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৪০/৩।

কাফেরদের বিরোধিতা, অপপ্রচার ও জুলুম-নির্যাতনের পরও রাসূল (ﷺ) তার দাওয়াতি কাজে একটুও দুর্বল হননি। তার দাওয়াতের মাধ্যমে যারা ইসলামে প্রবেশ করছে, তাদের তালীম-তারবীয়ত দেয়া ও দ্বীনের সুযোগ্য সৈনিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি কোন প্রকার কার্পণ্য ও নমনীয়তা প্রদর্শন করেননি। কুরাইশদের চোখকে ফাকি দিয়ে রাসূল (ﷺ) মুসলিমদের নিয়ে পরিবারের বিভিন্ন ঘরে একত্র হত। রাসূল (ﷺ) এর তালীম ও তরবীয়তের ফলে ধীরে ধীরে তার অনুসারীরা এমন একটি সাহসী ও ত্যাগী জাতিতে পরিণত হল, পৃথিবীর ইতিহাসে তাদের দৃষ্টান্ত দুর্লভ। তারা ইসলামকে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যাবতীয় সব ধরনের- দৈহিক ও মানসিক- নির্যাতন সইতে প্রস্তুত ছিল; যত প্রকার জুলুম নির্যাতনই আসুক না কেন, তারা তাদের আদর্শ হতে একটুও পিছপা হবে না বলে ছিল প্রত্যয়ী। রাসূল (ﷺ) এর তালীম তরবিয়ত ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় বিশেষ একটি জামাত তৈরি হল, যারা তাদের ঈমানে ছিল দৃঢ়, বিশ্বাসে ছিল অটুট, দায়িত্ব সম্পর্কে ছিল সচেতন, তাদের প্রভুর নির্দেশ পালনে তারা ছিল একনিষ্ঠ, রাসূলের নেতৃত্বর উপর ছিল তারা আস্থাভাজান। রাসূল (ﷺ) যে কোন নির্দেশ দিতেন, তা পালনে তারা ছিল অতীব আন্তরিক ও উৎসাহী। তার মুখের থেকে কোন কথা বের হতে দেরী হত, কিন্তু তারা তা লোপয়ে নিতে একটুও সময় ক্ষেপণ করত না। তারা তার নেতৃত্বের প্রতি এতই অনুগত ছিল, পৃথিবীর ইতিহাসে এর দ্বিতীয় কোন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা তাকে এত বেশি মুহাব্বত করত ও ভালোবাসতো যার কোন তুলনা আজ পর্যন্ত কোন জাতি উপস্থাপন করতে পারেনি।

এভাবেই রাসূল (ﷺ) তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, সঠিক দিক নির্দেশনা ও অটুট-অবিচল নীতি আদর্শের কারণে রিস্বলাতের গুরু দায়িত্ব আদায়, আমানতের সংরক্ষণ ও উম্মতের কল্যাণ নিশ্চিত করতে সক্ষম হন। তিনি আজীবন আল্লাহর রাহে সত্যিকার সংগ্রাম চালিয়ে যান। তিনি মানবজাতির জন্য এমন এক পথ ও পদ্ধতি বাতিয়ে দেন, যা আমাদের দাওয়াত, কর্ম ও চলার পথের জন্য চিরন্তন আদর্শ।

মোট কথা, তিনিই আমাদের আদর্শ, আমাদের ইমাম; আমরা তার আদর্শের অনুসারী ও তার হিকমত ও জ্ঞানের আলোয় আলোকিত।

তিনি অতীব পছন্দনীয়, সর্বো কৃষ্ট পদ্ধতি ও উন্নত মূলনীতি দিয়ে মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের প্রতি দাওয়াত দেয়া আরম্ভ করেন; যার ফলে মানুষ তার দাওয়াতে সাড়া দিয়ে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে এবং তার রিস্বলাতের উপর বিশ্বাস করে। একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, তার দাওয়াত কোন শ্রেণী বা গোষ্ঠীর জন্য খাস ছিল না, তার দাওয়াত ছিল ব্যাপক, সমগ্র মানুষের জন্য আর তিনি ছিলেন সমগ্র মাখলুকের জন্য রহমত।

রাসূল (ﷺ) যখন তার দাওয়াতি ময়দানে কাজ করছিলেন, তখন তিনি এমন কতক লোকদের চিহ্নিত করেন, যাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের যোগ্যতা ও প্রতিভা ছিল বিদ্যমান। এছাড়াও যাদের ব্যাপারে তিনি আশাবাদী ছিলেন যে, তারা তার দাওয়াত কবুল করবে এবং তার রিস্বলাতে বিশ্বাস করবে, তাদেরকেই তার দাওয়াতের জন্য প্রাথমিকভাবে চয়ন করেন। রাসূল (ﷺ) তার কৌশল ও হিকমতের কারণে এমন একটি ভিত রচনা করতে সক্ষম হন, যার উপর স্থাপিত হয় দাওয়াতের ভিত্তি। এমন কতক খুঁটি তৈরি করেন, যাদের উপর নির্ভর করে দাওয়াতের রোকনসমূহ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মাহমুদ সাকের রহ. এর তারিখে ইসলামী: ৬৫/২

আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াতের জন্য রাসূলের প্রচেষ্টায় কোন প্রকার ঘাটতি ছিল না। তিনি অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যান এবং প্রতিদিনই নতুন নতুন কৌশল ও হিকমত আবিষ্কার করেন। কিন্তু এত চেষ্টা সত্ত্বেও একটি কথা স্পষ্ট যে, রাসূল (ﷺ) কখনোই কাউকে হত্যা বা গুপ্ত হত্যা করার নির্দেশ দেননি। ইসলামের বিরোধিতা-কারী হিসেবে সে যত বড় দুশমনই হোক না কেন, তাকে তিনি নিজে বা তার সাহাবীদের কেউ গোপনে হত্যা করেনি। অথচ তখন গোপনে হত্যা করা সহজ ও সম্ভব ছিল; ইচ্ছা করলে তা করতে পারতেন। তা সত্ত্বেও রাসূল (ﷺ) কোন কাফের বা ইসলামের দুশমনকে গোপনে হত্যা করে, তার উপর পরিচালিত জুলুম নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেতে চাননি। রাসূল (ﷺ) যদি ইশারা করতেন, তাহলে এ কাজটি করার জন্য প্রস্তুত সাহাবীর অভাব ছিল না। তিনি সাহাবীদেরকে বড় বড় কাফের নেতা ও ইসলামের দুশমনদের গোপনে হত্যা করার নির্দেশ দিলে, তারা তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দিত। যেমন, ওলীদ ইবনে মুগীরা আল মাখযুমী, আস ইবনে ওয়ায়েল আসসাহমী, আবু জাহেল আমর ইবনে হেশাম, আবু লাহাব, আব্দুল উজ্জা ইবনে আব্দুল মুত্তালেব, নজর ইবনে হারেস, উকবা ইবনে আবু মুয়িত, উবাই ইবনে খলফ ও উমাইয়া ইবনে খলফ প্রমুখ। এরা সবাই ইসলামের ঘোর বিরোধী ও বড় বড় শত্রু ছিল। এরা রাসূল (ﷺ) কে অবর্ণনীয় ও সীমাহীন কষ্ট দিত। তারপরও রাসূল এদের কাউকে বা এরা ছাড়াও ইসলামের অন্য কোন দুশমনকে গোপনে হত্যা করেননি এবং হত্যার নির্দেশ দেননি। কারণ, এ ধরনের কাণ্ড-জ্ঞানহীন কাজ ইসলামের অগ্রযাত্রার জন্য ক্ষতিকর। যারা এ ধরনের কাজ করে ইসলামের দুশমনরা তাদের একেবারে নি:শেষ করে দেয় অথবা তাদের অগ্রসর হওয়ার পথকে রুদ্ধ করে দেয়। যেমনটি আজ আমরা সমগ্র দুনিয়া ব্যাপী বিষয় ভালোভাবেই প্রত্যক্ষ করি। ইসলামের দুশমন যারা ইসলামকে নির্মূল করতে চায়, তাদের দ্বারা আজ আমরা আক্রান্ত ও ভুক্তভোগী। আল্লাহর পক্ষ হতেও তার নবীকে এ ধরনের গোপনীয় কোন কিছু করার নির্দেশ দেয়া হয়নি। কারণ, তিনি-তো আহকামুল হাকেমীন- মহা জ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ; তিনি যাবতীয় কর্মের বিদারক ও পরিণতি সম্পর্কে সম্যক অবগত।

একটি কথা মনে রাখতে হবে, জমিনের উপর ও আসমানের নিচে যত দা‘ঈ আছে, তাদের সবাইকে কিয়ামত পর্যন্ত ঐ পথেরই অনুসরণ করতে হবে, যে পথ রাসূল (ﷺ) আমাদের জন্য তার হিজরতের পূর্বে ও পরে দেখিয়ে গেছেন। সুতরাং, মনে রাখতে হবে, বিশুদ্ধ দাওয়াতের পদ্ধতি হল, রাসূলের শিক্ষা ও আদর্শকে আঁকড়িয়ে ধরা, তার আখলাক ও চরিত্রের অনুসরণ করা; তিনি যেভাবে দাওয়াতের কাজ করেছেন, সেভাবে দাওয়াতি কাজকে আঞ্জাম দেয়া। মাহমুদ সাকের রহ. এর তারিখে ইসলামী: ৬৫/২

 দুই.
কুরাইশ প্রতিনিধিদের প্রস্তাবে রাসূল (ﷺ) এর অসম্মতি এবং আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াতের উপর তার অটুট ও অবিচল নীতি কুরাইশদের হতাশা বৃদ্ধি করে।

কুরাইশরা রাসূল (ﷺ) কে তার দাওয়াতি কার্যক্রম হতে কোন ভাবেই বিরত রাখতে পারছিল না। তাদের জুলুম, নির্যাতন ও নির্মম অত্যাচার কোনটাই কাজে আসতে ছিল না। নিরুপায় হয়ে তারা রাসূল (ﷺ) কে থামানো ও ধময়ে রাখার আরেকটি নতুন কৌশল অবলম্বন করল; যে কৌশলের মূল থিম হল, তারা রাসূলকে একদিকে প্রলোভন দিবে অপরদিকে তারা তাকে ভয় দেখাবে। তাদের কৌশল হল, তারা উভয়টিকে একত্র করে তাকে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করবে। একদিকে তারা রাসূল (ﷺ) কে পার্থিব জগতের যত চাহিদা আছে সব কিছুই তারা তাকে দিতে প্রস্তুত আর অপরদিকে তার চাচা-আবু তালিব- যিনি তাকে দেখা-শোনা ও সাহায্য সহযোগিতা করে, তাকে সতর্ক করবে, যাতে তিনি মুহাম্মদকে তার দ্বীনের প্রচার হতে বিরত রাখে। আল বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ৪১/৩ মুহাম্মাদ আল গাযালী রহ. এর সীরাত গ্রন্থ পৃ: ১১২

কুরাইশদের কৌশল ছিল নিম্নরূপ:
 এক.
কুরাইশ নেতারা আবু তালেবের নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, হে আবু তালেব! তুমি বয়সে আমাদের জ্যৈষ্ঠ, আমাদের মধ্যে তোমার যথেষ্ট ইজ্জত ও সম্মান রয়েছে। তুমি জান! আমরা তোমার ভাতিজাকে আল্লাহর দ্বীন ও তাওয়াহ্‌য়ীদের দাওয়াত দেয়া হতে বিরত থাকতে বার বার বলছি, কিন্তু সে আমাদের কথায় কোন প্রকার কর্ণপাত করেনি এবং তাওয়াহ্‌য়ীদের দাওয়াত দেয়া হতে বিরত থাকেনি। আমরা আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমরা তার এ অবস্থার উপর আর বেশিদিন ধৈর্য ধারণ করতে পারছিনা। সে আমাদের বাপ-দাদার সমালোচনা করে, আমাদের উপাস্যদের বদনাম করে এবং আমাদের চিন্তা চেতনার উপর কুঠার আঘাত করে। তুমি হয়তো তাকে বিরত রাখবে অন্যথায় তার সাথে ও তোমার সাথে আমরা যুদ্ধে অবতীর্ণ হব; হয় তোমরা ধ্বংস হবে অথবা আমরা ধ্বংস হব।

আবু তালেবের নিকট কুরাইশদের এ ধরনের কঠিন হুমকি, সগোত্রীয় লোকদের বিরোধিতা ও তাদের সাথে সম্পর্কের টানা-পোড়ন, একটি দু:শ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াল। কুরাইশ নেতাদের এ ধরনের কথার কারণে সে রাসূল (ﷺ) ইসলামের প্রতি যে দাওয়াত দিচ্ছে, তাতে তিনি খুশি হতে পারলেন না, আবার অন্যদিকে তারা মুহাম্মদকে অপমান করবে তাতেও তিনি সন্তুষ্ট নয়। তাই নিরুপায় হয়ে আবু তালেব রাসূল (ﷺ) কে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, হে ভাতিজা! তোমার গোত্রের লোকেরা আমার নিকট এসেছিল, তারা আমাকে এসব কথা বলেছে, আমি আমার ও তোমার উভয়ের বিষয়ে আশংকা করছি। তুমি আমার উপর এমন কোন দায়িত্ব চাপাবে না, যা বহন করতে আমি বা তুমি অক্ষম। সুতরাং তোমার যে কথা তারা অপছন্দ করে তা বলা হতে তুমি নিজেকে বিরত রাখ!

আবু তালেবের এ প্রস্তাবে রাসূল (ﷺ) কোন প্রকার ভ্রুক্ষেপ না করে, তিনি তার দাওয়াতের উপর অটল ও অবিচল রইলেন। তিনি আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দেয়া হতে বিন্দু পরিমাণও পিছ-পা হলেন না। যারা তার সমালোচনা এ বিরোধিতা করল তাদের বিরোধিতা ও সমালোচনাকে তিনি কোন প্রকার ভয় করলেন না। কারণ, তিনি জানেন, তিনি সত্যের উপর আছেন, আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই তার দ্বীনকে বিজয় করবে এবং তার বাণীকে সমুন্নত রাখবে। আবু তালেব যখন রাসূলের দৃঢ়টা ও অবিচলতা দেখতে পেল এবং তার কথায় তার ভাতিজা তাওয়াহ্‌য়ীদের দিকে দাওয়াত দেয়া ছেড়ে দেবে, এ ধরনের আশা ছেড়ে দিল, সে তাকে বলল,
واللَّه لن يصلوا إليك بجمعهم
حتى أُوسَّد في التراب دفينا
فاصدع بأمرك ما عليك غضاضة
وأبشر وقر بذاك منك عيونا
অর্থ, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, তারা সবাই একত্র হয়েও তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। যদি তারা তোমার কোন ক্ষতি করে, আমি তাদেরকে মাটিতে দাফন করে ফেলব। তুমি তোমার কাজ চালিয়ে যাও! তোমার কোন ভয় নাই। আর তুমি আমার পক্ষ হতে সু-সংবাদ গ্রহণ কর এবং তুমি তোমার চক্ষুকে শীতল কর। দেখুন! সীরাতে ইবনে হিশাম ২৭৮/২, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৪২/৩, ৩ মুহাম্মাদ আল গাযালী রহ. এর সীরাত: পৃ: ১১৪ রাহীকুল মাখতুম: পৃ: ৯৪।

 দুই
ওমর ইবনুল খাত্তাবের ইসলাম ও হামযা ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের ইসলাম গ্রহণের পর ইসলামের কালো আকাশ হতে মেঘ সরে যেতে আরম্ভ করল। ইসলাম ও মুসলিমদের যে অবস্থান তৈরি হল, তা দেখে মক্কার কাফের মুশরিকদের ঘুম হারাম হয়ে গেল। মুসলিমদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়া, তারা প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দেয়া ও মুশরিকদের বিরোধিতার কোন প্রকার তওক্কা না করা, তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করল ও রীতিমত তারা আতংকিত হয়ে পড়ল।

কোন প্রকার উপায় না দেখে, রাসূল (ﷺ) এর নিকট কুরাইশরা তাদের নেতাদের আবারো পাঠালেন, যাতে তারা তাকে এমন কিছু পার্থিব বিষয়ে লোভ দেখায়, যেগুলোর প্রতি প্রলুব্ধ হয়ে, সে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দেয়া ছেড়ে দেয়। তারা ঠিক করল, যদি মুহাম্মাদ তাদের প্রস্তাবে রাজি হয়, তাহলে তাকে দুনিয়াবি ও পার্থিব জগতের অসংখ্য অগণিত সুযোগ-সুবিধা দেবে। তার যত প্রকার চাহিদা আছে তা সবই তারা পূরণ করবে।

তাদের চিন্তা চেতনা অনুযায়ী কুরাইশ নেতা উতবা রাসূল (ﷺ) এর দরবারে এসে তার নিকট বসল এবং বলল, হে আমার ভাতিজা! তুমি আমাদের মধ্যে কতটুকু আদর ও সম্মানের তা তোমার অজানা নয়, তোমার বংশ মর্যাদার কোন তুলনা হয় না। কিন্তু তুমি গোত্রের লোকদের নিকট এমন একটি বিষয় উপস্থাপন করছ, যা তাদের ঐক্যে পাটল ধরিয়েছ, চিন্তা চেতনায় আঘাত হানছে, দীর্ঘদিন থেকে লালিত স্বপ্নকে তুমি ভঙ্গুর করে দিয়েছ। এ ছাড়াও তুমি তাদের ইলাহ ও ধর্মকে তুমি কটাক্ষ করছ এবং তাদের বাপ-দাদাদের রীতিনীতিকে অস্বীকার করছ। আমি তোমার নিকট কিছু প্রস্তাব নিয়ে এসেছি তুমি মনোযোগ দিয়ে শোন এবং গভীরভাবে চিন্তা করে দেখ, হয়তো, বিষয়গুলো তোমার নিকট ভালো লাগবে এবং তুমি তার কিছু হলেও গ্রহণ করবে। তার কথা শোনে রাসূল (ﷺ) বললেন, ((قل أبا الوليد أسمع)) হে আবুল ওয়ালিদ! তুমি তোমার কথা বল, আমি তোমার কথা শুনবো! তখন সে বলল, হে ভাতিজা! যদি তোমার এ দাওয়াতের দ্বারা ধন-সম্পদ উপার্জন করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে তুমি বল, আমরা তোমার চাহিদা অনুযায়ী ধন-সম্পদ তোমার জন্য একত্র করব। ফলে তুমি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে অধিক সম্পদের অধিকারী হবে। আর যদি তুমি আমাদের নেতৃত্ব দিতে চাও, তাহলে আমরা তোমাকে আমাদের নেতা নির্বাচিত করব এবং আমরা তোমাদের নেতৃত্বকে মেনে নেব। আমরা তোমার সিদ্ধান্ত ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব না। তুমি আমাদের যখন যা করতে বল, আমরা তাই করব এবং তোমার অনুগত হয়ে চলব। আর যদি তুমি আমাদের রাজত্ব চাও, তাতেও আমরা রাজি। আমরা তোমাকে আমাদের রাজা বানিয়ে দেব।

আর তুমি যা করছ ও বলছ, তা যদি কোন রোগের কারণে হয়, তবে আমরা তোমার জন্য কবিরাজ বা ডাক্তারের সন্ধান করব এবং তোমার যত ধরনের চিকিৎসা প্রয়োজন তার সবই আমরা করব। তোমার চিকিৎসার জন্য যত টাকা প্রয়োজন আমরা খরচ করব। রাসূল (ﷺ) উতবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। তারপর যখন উতবা তার কথা শেষ করল, তখন রাসূল (ﷺ) বললেন,
((أفرغت أبا الوليد؟)) قال نعم، قال: ((فاستمع مني)) قال: افعل، فقال: ﴿بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيم * حم * تَنزِيلٌ مِّنَ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ * كِتَابٌ فُصِّلَتْ آيَاتُهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لِّقَوْمٍ يَعْلَمُونَ * بَشِيرًا وَنَذِيرًا فَأَعْرَضَ أَكْثَرُهُمْ فَهُمْ لا يَسْمَعُونَ * وَقَالُوا قُلُوبُنَا فِي أَكِنَّةٍ مِّمَّا تَدْعُونَا إِلَيْهِ ... ﴾
হে আবুল ওয়ালিদ! তুমি তোমার কথা শেষ করছ? বলল, হ্যাঁ। তাহলে এবার তুমি আমার থেকে কিছু কথা মনোযোগ দিয়ে শোন। তখন সে বলল, আচ্ছা এবার তুমি বল, তখন রাসূল (ﷺ) বলল, তুমি আমার থেকে কুরআনের আয়াত শোন। তারপর রাসূল (ﷺ) কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করছিল। উতবা চুপ করে রাসূল (ﷺ) এর তিলাওয়াত শুনছিল। উতবা দুই হাত পিছনের দিক দিয়ে হেলান দিয়ে বসে কুরআনের তিলাওয়াত শুনছে। রাসূল (ﷺ) তিলাওয়াত করতে করতে যখন সেজদার আয়াত পর্যন্ত পৌঁছল, তখন সে সেজদায় পড়ে গেল।সূরা ফুস্সিলাত, আয়াত: ১৩। তারপর রাসূল তাকে বলল, হে আবুল ওলিদ! তুমি আমার কাছ থেকে যা শুনলে, এটাই হল আমার মিশন। এখন তুমি চিন্তা করে দেখ কি করবে?

অপর এক বর্ণনায় বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) যখন এ আয়াত পর্যন্ত পৌঁছল,
﴿فَإِنۡ أَعۡرَضُواْ فَقُلۡ أَنذَرۡتُكُمۡ صَٰعِقَة مِّثۡلَ صَٰعِقَةِ عَاد وَثَمُودَ﴾ [فصلت: 13]
অর্থ, অত:পর যদি তারা প্রত্যাখ্যান করে তুমি তাদের বল, আমি তোমাদের আদ ও সামুদ সম্প্রদায়ের লোকদের বিকট শব্দের মত শব্দের ভয় দেখাচ্ছি! উতবা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রাসূল (ﷺ) এর মুখ চেপে ধরল এবং বলল, আমি তোমাকে আল্লাহর শপথ ও আত্মীয়তার শপথ করে বলছি, আর তিলাওয়াত করো না! তুমি তোমার তেলাওয়াত বন্ধ কর। তারপর সে তার বংশের লোকদের নিকট এমনভাবে দৌড়ে আসল যেন বজ্র বা বিদ্যু তাকে তাড়া করছে। আর কুরাইশদের সে বলল, তোমরা মুহাম্মদকে তার আপন অবস্থায় ছেড়ে দাও; তার সাথে তোমরা বাড়াবাড়ি করো না। সে তাদের বিষয়টি বুঝাতে আরম্ভ করেন। আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৬২/৩, তাফসীরে ইবনে কাসীর: ৬২/৪, ইমাম শামছুদ্দিন আয-যাহাবী রহ. সীরাত গ্রন্থ: পৃ: ১৫৮। মুহাম্মাদ আল গাযালী রহ. এর সীরাত: পৃ: ১১৪ এবং হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব: পৃ: ১০২।

লক্ষণীয় বিষয় হল, রাসূল (ﷺ) আল্লাহর মেহেরবানী, স্বীয় বুদ্ধিমত্তা ও হিকমতের মাধ্যমে এমন একটি আয়াত নির্বাচন করেন, যে আয়াতে আল্লাহর পক্ষ হতে প্রেরিত রাসূল ও রিস্বলাতের মর্মবাণী উপস্থাপিত ছিল এবং তাতে এ কথা স্পষ্ট করা হল যে, রাসূল (ﷺ) আল্লাহর পক্ষ থেকে মাখলুকের নিকট এমন একটি কিতাব নিয়ে এসেছেন, যে কিতাব তাদের গোমরাহি থেকে হেদায়েতের দিকে ডাকে এবং তাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখায়। আর মুহাম্মাদ (ﷺ) হল, এ কিতাবের উপর বিশ্বাস করা, তদনুযায়ী আ‘মাল করা ও তার আহ্কাম সম্পর্কে অবগত হওয়া বিষয়ে সর্বাগ্রে দায়িত্বশীল। যদি আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে অবিচল থাকার নির্দেশ দেন, সে বিষয়ে মুহাম্মদই (ﷺ) ই হল সর্বাধিক উপযুক্ত ব্যক্তি। তিনি কোন রাজত্ব চান না, ধন-সম্পদ চান না এবং ইজ্জত সম্মান লাভের প্রতি তার কোন অভিলাষ নাই। আল্লাহ তা‘আলা তাকে এগুলো সবই দিয়েছেন; যার ফলে তিনি ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার পচা-গন্ধ জিনিষের প্রতি হাত বাড়ানো থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকেন। কারণ, তিনি তার দাওয়াতে একজন সত্যবাদী আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া দায়িত্ব পালনে একনিষ্ঠ। মুহাম্মাদ আল গাযালী রহ. এর সীরাত: পৃ: ১১৩

রাসূল (ﷺ) আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত যে হিকমত অবলম্বন করেন, তা যে কত মহান ছিল তার বর্ণনা কখনো শেষ করা যাবে না। তিনি তার দাওয়াতে ছিল সবচেয়ে সত্যবাদী। তার মধ্যে ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা, ইজ্জত-সম্মান, নারী-বাড়ী, গাড়ী কোন কিছুর প্রতি তার কোন লোভ ছিল না। তাই রাসূল (ﷺ) ওয়ালিদকে সময় উপযোগী কথা শোনান যার উপর সে অভিভূত হয়ে পড়ে এবং তার নিকট তার গ্রহণ যোগ্যতা বেড়ে যায়। এটাই হল, প্রকৃত হিকমত ও বুদ্ধিমত্তা।

 তিন:
মুশরিকরা সিদ্ধান্ত নিলো যে, ইসলাম ও মুসলিম বিরুদ্ধে এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) কে কষ্ট দেয়ার ক্ষেত্রে যা যা করা দরকার আমরা তাই করব। যে দিন থেকে রাসূল প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেয়া ও জাহিলিয়্যাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আরম্ভ করেন, সেদিন থেকে মক্কাবাসীদের ক্রোধের আর অন্ত রইল না। তারা ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। মুসলিমরা তাদের নিকট একটি নিকৃষ্ট ও অপরাধী জাতিতে পরিণত হল। তারা বুঝতে পারল যে, তাদের পায়ের নিচ থেকে ধীরে ধীরে মাটি সরে যাচ্ছে। নিরাপত্তা বেষ্টিত হেরম এলাকায় তাদের ধন-সম্পদ, ইজ্জত সম্মান ও জীবনের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ছে। ফলে তারা মুসলিমদের সাথে ঠাট্টা বিদ্রূপ, তাদের উপর মিথ্যা-রোপ, ইসলামী শিক্ষার বিরুদ্ধে অপপ্রচার, ইসলামের বিষয়ে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি, মিথ্যা অপবাদ দেয়াসহ হাজারো ষড়যন্ত্র শুরু করে। কুরআনের অবমাননা, কুরআন সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের কটূক্তি- কুরআন হল পূর্বেকার লোকদের বানানো ও বানোয়াট কাহিনী- করে। এ ছাড়া তারা মুহাম্মদ (ﷺ) কে তাদের ইলাহগুলোর ইবাদত ও আল্লাহর ইবাদত এক সাথে চালিয়ে যাওয়ার জন্য বাধ্য করে।

রাসূল (ﷺ) কে পাগল, যাদুকর, মিথ্যুক গণক ইত্যাদি বলে, তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার চালায়। কিন্তু এত কিছুর পরও রাসূল (ﷺ) বিন্দু পরিমাণ ও পিছপা হননি; তিনি ধৈর্য ধারণ করেন এবং আল্লাহর পক্ষ হতে দ্বীনের বিষয়ে তাকে সাহায্য করা হবে এ আশায় কাজ চালিয়ে যান। দেখুন: ইমাম গাযালী রহ. এর ফিকহুস সীরাহ: পৃ: ১০৬, রাহীকুল মাখতুম পৃ: ৮০, ৮২। মাহমুদ শাকেরের তারিখে ইসলামী: ৮৫/২ এবং হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব: ১১০।

মুশরিকরা রাসূল (ﷺ) এর উপর এমন এমন অমানবিক নির্যাতন চালাতে আরম্ভ করে, যা অনেক সময় একজন সাধারণ মুসলিমের উপরও চালাত না। এমনকি আবু জাহেল রাসূল (ﷺ) কে ধুলায় মিটিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাকে আবু জাহেলের হাত থেকে হেফাজত করে এবং তার ষড়যন্ত্রকে বানচাল করে দেয়। যেমন, আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আবু জাহেল বলল, মুহাম্মদ কি তোমাদের সামনে মাটিতে মাথা ঝুঁকায়? তাকে উত্তর দেয়া হল, হ্যাঁ! তখন সে বলল, লাত ও উজ্জার নামে কসম করে বলছি, আমি যদি তাকে মাটিতে মাথা ঝুঁকাতে দেখি, আমি তার ঘাড়ে পারাবো অথবা তার চেহারাকে মাটিতে মিশিয়ে দেব ! তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) যখন স্বলাত আদায় করতে ছিল, ঠিক তখন সে উপস্থিত হল, তারপর রাসূল (ﷺ) যখন সেজদায় যায়, তখন সে তার ঘাড়ে পা রাখার জন্য অগ্রসর হচ্ছিল; কিন্তু সে পারলো না। যখন সে সামনের দিক যাইতেছিল তখন সে সামনের দিক যাইতে পারল না বরং সে আরও পিছচ্ছিল এবং দু হাত দিয়ে নিজেকে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করছিল। তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, কি ব্যাপার তোমার কি হয়েছে? তখন সে বলল, আমি দেখতে পেলাম আমার ও তার মাঝে আগুনের একটি পরিখা, মহা প্রলয় ও শক্তিশালী বাহু! রাসূল (ﷺ) বললেন, যদি সে আমার কাছে আসত, তাহলে ফেরেশতারা তাকে টুকরা টুকরা করে চিনিয়ে নিত। তিনি বলেন, তারপর আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন। ইমাম মুসলিম মুনাফিক অধ্যায়; পরিচ্ছেদ: আল্লাহ তা‘আলার বাণীর তাফসীরে ﴿كَلا إِنَّ الإِنسَانَ لَيَطْغَى، أَن رَّآهُ اسْتَغْنَى﴾ হাদীস নং ২১৪৫/৪, ২৭৯৭, আরো দেখুন শরহে নববী ১৪০/১৭।

আল্লাহ তা‘আলা রাসূলকে এত বড় জালেমের হাত থেকে রক্ষা করেন। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে রাসূল (ﷺ) এ ধরনের হাজারো জুলুম নির্যাতন সহ্য করেন এবং তিনি তার জান-মাল ও সময় তার রাহে ব্যয় করেন।

 চার:
ইসলামের শত্রু আবু জাহেলের লেলিয়ে দেয়ার কারণে রাসূল (ﷺ) যে নির্যাতনের স্বীকার হন তার বিবরণ:
ما رواه ابن مسعود رضي الله عنه قال: بينما رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم يصلي عند البيت، وأبو جهل وأصحاب لـه جلوس، وقد نحرت جزور بالأمس، فقال أبو جهل: أيكم يقوم إلى سلا جزور بني فلان، فيأخذه فيضعه على ظهر محمد إذا سجد، فانبعث أشقى القوم فأخذه، فلما سجد النبي صلى الله عليه وسلم وضعه بين كتفيه، قال: فاستضحكوا، وجعل بعضهم يميل على بعض، وأنا أنظر، لو كانت لي منعة طرحته عن ظهر رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم، والنبي صلى الله عليه وسلم ساجد ما يرفع رأسه، حتى انطلق إنسان فأخبر فاطمة،
فجاءت وهي جويرية، فطرحته عنه، ثم أقبلت عليهم تشتمهم، فلما قضى النبي صلى الله عليه وسلم صلاته، رفع صوته، ثم دعا عليهم، وكان إذا دعا دعا ثلاثاً، وإذا سأل سأل ثلاثاً، ثم قال: ((اللَّهم عليك بقريش)) ثلاث مرات، فلما سمعوا صوته ذهب عنهم الضحك، وخافوا دعوته، ثم قال: ((اللَّهم عليك بأبي جهل بن هشام، وعتبة بن ربيعة، وشيبة بن ربيعة، والوليد بن عتبة، وأمية بن خلف، وعقبة بن أبي معيط))، وذكر السابع ولم أحفظه، فوالذي بعث محمداً صلى الله عليه وسلم بالحق لقد رأيت الذي سمى صرعى يوم بدر، ثم سحبوا إلى القليب، قليب بدر. »

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন একদা রাসূল (ﷺ) কাবার পাশে স্বলাত আদায় করছিল। আবু জাহেল তার সাথী সঙ্গীদের নিয়ে একটি মজলিশে বসা ছিল। বিগত দিনের জবেহ-কৃত একটি উটের ভূরি পড়ে আছে দেখে, আবু জাহেল বলল, তোমাদের মধ্যে কে আছে যে অমুক গোত্রের ভুঁড়িটি নিয়ে মুহাম্মদ যখন সেজদা করে তখন তার মাথার উপর রেখে দিবে? তার একথা শোনে সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ- উকবা ইবনে আবি মুইত- উঠে দাঁড়ালো এবং সে দৌড়ে গিয়ে ভুঁড়িটি নিয়ে রাসূল (ﷺ) সেজদায় গেলে তার দুই কাঁধের উপর রেখে দেয়। বর্ণনাকারী বলেন, তারপর তারা হাসাহাসি করতে আরম্ভ করে। হাসতে হাসতে তারা একে অপরের উপর ঢলে পড়ল। আমি নীরবে এ দৃশ্য দেখতে ছিলাম, আমার কিছুই করার ছিল না। সেদিন আমার যদি ক্ষমতা থাকত, তাহলে আমি রাসূল (ﷺ) এর ঘাড় থেকে তা সরিয়ে দিতাম। রাসূল (ﷺ) সেজদায় পড়ে আছেন, কোন ক্রমেই মাথা উঠাতে পারছিল না। একজন পথিক এ দৃশ্য দেখে ফাতেমা (রাঃ) কে খবর দিলেন, খবর পেয়ে সে দৌড়ে আসল এবং তার ঘাড়ের উপর থেকে ভুঁড়িটি সরাল। অসহ্য হয়ে সে কাফেরদের সামনে এসে তাদের কিছুক্ষণ গালি-গালাজ করল। তারপর যখন রাসূল (ﷺ) স্বলাত আদায় সম্পন্ন করেন, তিনি উচ্চস্বরে তাদের জন্য বদদোয়া করলেন। রাসূল (ﷺ) যখন কোন দোয়া করতেন তিনবার দোয়া করতেন আবার যখন কোন কিছু চাইতেন তখনও তিন বার চাইতেন। রাসূল (ﷺ) দুহাত তুলে তিনবার বললেন, হে আল্লাহ! তুমি কুরাইশদের পাকড়াও কর! কাফেররা তার বদদোয়ার আওয়াজ শোনে, আতংকিত হয় এবং তাদের মুখের হাসি বন্ধ হয়ে যায়। তারপর তিনি বললেন, হে আল্লাহ! তুমি আবু জাহেল ইবনে হিশাম, উতবা ইবনে রাবিয়াহ, ওয়ালিদ ইবনে উতবা, উমাইয়া ইবনে খলফ ও উকবা ইবনে আবি মুইত প্রমুখ ধ্বংস কর। রাসূল (ﷺ) সাতজন ব্যক্তির নাম নেন, কিন্তু সপ্তম ব্যক্তির নামটি আমি ভুলে যাই। বর্ণনাকারী বলেন, যে আল্লাহ মুহাম্মাদ (ﷺ) কে সত্যের বাণী নিয়ে দুনিয়াতে পাঠান, তার শপথ করে বলছি, রাসূল যাদের নাম নিয়েছে তাদেরকে বদরের দিন বদর প্রান্তে চিত হয়ে পড়ে থাকতে দেখি। তারপর গলায় রশি লাগিয়ে তাদের বদর প্রান্তের কুপের দিকে টেনে হেঁচড়ে নেয়া হয়। বুখারি ওজু অধ্যায়: পরিচ্ছেদ কোন মুসল্লির উপর স্বলাত রত অবস্থায় কোন মরা বস্তু বা নাপাকি নিক্ষেপ করা হয়, তাহলে তার স্বলাত বাতিল হবে না। হাদীস ২৪০, ৩৪৯/১ এবং মুসলিম কিতাবুল জিহাদ। পরিচ্ছেদ: মুশরিক ও মুনাফিকরা রাসূল (ﷺ) যে সব নির্যাতন করে তার বিবরণ। হাদীস নং ১৭৯৪, ১৪১৮/২

 পাঁচ:
রাসূল (ﷺ) এর সাথে মুশরেকদের সবচেয়ে জঘন্য ও খারাপ দুর্ব্যবহারের বর্ণনা:
عن عروة بن الزبير، قال: قلت لعبد اللَّه بن عمرو بن العاص: أخبرني بأشد ما صنع المشركون برسول اللَّه صلى الله عليه وسلم؟ قال: بينما رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم يصلي في حجر الكعبة، إذ أقبل عقبة بن أبي معيط، فأخذ بمنكب رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم ولوى ثوبه في عنقه، فخنقه خنقاً شديداً، فأقبل أبو بكر، فأخذ بمنكبه، ودفعه عن رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم وقال: ﴿أَتَقْتُلُونَ رَجُلا أَن يَقُولَ رَبِّيَ اللَّهُ وَقَدْ جَاءَكُم بِالْبَيِّنَاتِ مِن رَّبِّكُمْ».
উরওয়া ইবনে যুবাইর রা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাঃ) বলি, মুশরিকরা রাসূল (ﷺ) এর সাথে সবচেয়ে খারাপ যে ব্যবহার করে, তুমি আমাকে তার বিবরণ দাও! তিনি বলেন, একদিন রাসূল (ﷺ) কাবা গৃহের পাশে স্বলাত আদায় করছিল ঠিক ঐ মুহূর্তে উকবা ইবনে আবি মুয়াইত এসে রাসূল (ﷺ) এর গলা চেপে ধরল এবং কাপড় দিয়ে তার গলা পেঁচালো। তারপর খুব জোরে তার গল চেপে টানাটানি করে তাকে মেরে ফেলতে চেষ্টা করে। এ অবস্থা দেখে আবু বকর (রাঃ) দৌড়ে এসে তার দিকে অগ্রসর হল এবং তার ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে তাকে রাসূল (ﷺ) হতে দূরে সরাল। তারপর বলল,
﴿أَتَقۡتُلُونَ رَجُلًا أَن يَقُولَ رَبِّيَ ٱللَّهُ وَقَدۡ جَآءَكُم بِٱلۡبَيِّنَٰتِ مِن رَّبِّكُمۡۖ﴾ [غافر:28]
অর্থ, তোমরা এমন একজন লোককে হত্যা করবে যে বলে আমার রব আল্লাহ! অথচ সে তোমাদের রবের পক্ষ হতে স্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়েই তোমাদের নিকট এসেছে। সূরা গাফের, আয়াত: ২৮।

এভাবে মুশরিকরা রাসূল (ﷺ) ও তার সাথে যারা ঈমান এনেছে, সে সব মুসলিমদের উপর বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন চালাত। তার সাথীরা তাদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে, রাসূল (ﷺ) এর দরবারে এসে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করল। তার নিকট দোয়া চাইল এবং আল্লাহর নিকট সাহায্য চাওয়ার জন্য আবেদন জানাল। রাসূল (ﷺ) তাদেরকে আল্লাহর সাহায্য লাভ ও তাদের সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং বললেন, শেষ পরিণতি কেবলই মুত্তাকীদের জন্য।

খাব্বাব ইবনে আরত (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসূল (ﷺ) কাবা ঘরের ছায়াতলে একটি চাদরকে বালিশ বানিয়ে শুয়ে ছিল। আমরা তাকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করবেন না? আমাদের জন্য দোয়া করবেন না? তখন রাসূল আমাদের বললেন,
((قد كان من قبلكم يؤخذ الرجل فيحفر لـه في الأرض، فيجعل فيها، فيجاء بالمنشار فيوضع على رأسه فيجعل نصفين، ويمشط بأمشاط الحديد [ما دون عظامه من لحم وعصب]، فما يصده ذلك عن دينه، واللَّه ليُتَمَّنَّ هذا الأمر، حتى يسير الراكب من صنعاء إلى حضرموت لا يخاف إلا اللَّه والذئب على غنمه، ولكنكم تستعجلون».
তোমাদের পূর্বের উম্মতদের অবস্থা ছিল, তাদের একজন লোককে ধরে আনা হত, তারপর জমিনে তার জন্য গর্ত খনন করা হত এবং তাতে তাকে নিক্ষেপ করত। তারপর তার জন্য করাত আনা হত, আর সে করাত দ্বারা তার মাথাকে দ্বি-খণ্ড করে তাকে হত্যা করা হত। আবার কোন কোন সময় কাউকে কাউকে লোহার চিরুনি দিয়ে আচড় দিয়ে তার হাড় থেকে মাংস ও চামড়া তুলে নিয়ে আলাদা করা হত। এত বড় নির্যাতন সহ্য করা সত্ত্বেও তাদেরকে দ্বীন থেকে এক চুল পরিমাণও এদিক সেদিক করতে পারত না। [রাসূল বলেন] আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই এ দ্বীনকে পরিপূর্ণ করবে। এমনকি একজন সফরকারী সুনায়া থেকে হাজরা-মওত পর্যন্ত নিরাপদে ভ্রমণ করবে, সে তার নিরাপত্তার জন্য একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করবে না। তবে তোমরা হলে এমন জাতি, যারা তাড়াহুড়াকে পছন্দ কর। বুখারী, কিতাবুল মানাকেব পরিচ্ছেদ: ইসলামে নবুওয়তের আলামত ৬১৯/৬, (৩৬১২)। আনছারীদের মানাকেব অধ্যায় পরিচ্ছেদ: মক্কায় রাসূল (ﷺ) ও তার ছাহাবীরা মক্কায় মুশরিকদের পক্ষ হতে যে সব নির্যাতনের সম্মূখীন হন, তার বর্ণনা। কিতাবুল ইকরাহ।

নিরপরাধ মুসলিমদের উপর মুশরিকদের নির্যাতন দিন দিন আরও মারাত্মক আকার ধারণ করছিল। আল্লাহর উপর ঈমান আনা, হক গ্রহণ করা, আল্লাহর দ্বীনের উপর অবিচল থাকা এবং নিরেট তাওয়াহ্‌য়ীদের প্রতি দাওয়াত ও মূর্তি পূজাকে প্রত্যাখ্যান করাই ছিল তাদের একমাত্র অপরাধ।

 ছয়.
রাসূল (ﷺ) মুশরিকদের পক্ষ হতে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন সহ্য করে যাচ্ছেন। কিন্তু মুশরিকরা রাসূল (ﷺ) ও তার অনুসারী মুসলিমদের উপর শুধু নির্যাতন করেই ক্ষান্ত নন, বরং রাসূল (ﷺ) ও তার আনিত দ্বীনের প্রতি তাদের বিদ্বেষ ও ক্ষোভ এতই তীব্র ছিল, শেষ পর্যন্ত তারা কোন প্রকার উপায় অন্তর না দেখে তার নামকেও সহ্য করতে পারত না। ফলে তারা রাসূল (ﷺ) এর নামটিকে বিকৃত ও পরিবর্তন করে দেয়। প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষ বশত যে নামটি দ্বারা তার প্রশংসা বোঝাতো অর্থাৎ মুহাম্মদ তা পরিবর্তন করে, যে নাম দ্বারা তার বদনাম বুঝায় অর্থাৎ মুজাম্মাম, সে নাম বলে ডাকতে আরম্ভ করে। আর যখন তারা তার নাম উল্লেখ করত, তখন তারা বলত, আল্লাহ তা‘আলা মুজাম্মাম এর সাথে এ আচরণ করেন। অথচ মুজাম্মাম তার নাম নয় এবং এ নামে তিনি পরিচিতিও নয়। দেখুন ফতহুল বারী: ৫৫৮/৬ রাসূল (ﷺ) বলেন,
((ألا تعجبون كيف يصرف اللَّه عني شتم قريش، ولعنهم؟! يشتمون مذمماً، ويلعنون مذمماً، وأنا محمد))
অর্থ, তোমরা কি আশ্চর্যবোধ কর না! আল্লাহ তা‘আলা কীভাবে কুরাইশদের অভিশাপ ও গাল-মন্দকে আমার থেকে প্রতিহত করেন। তারা মুজাম্মামকে গালি দেয় ও অভিশাপ করে, আমি মুজাম্মাম নই আমি হলাম মুহাম্মাদ।বুখারি কিতাবুল মানাকেব হাদিস নং ৫৫৪/৬, ৩৫৩৩। রাসূল (ﷺ) এর পাঁচটি নাম আছে। তার মধ্যে তার একটি নামও মুজাম্মাম নাই। বুখারি কিতাবুল মানাকেব হাদিস নং ৫৫৪/৬, ৩৫৩৩।

সুরা লাহাব অবতীর্ণ হওয়ার পর আবু লাহাবের স্ত্রী রাসূল (ﷺ) এর দরবারে আসে। তখন তার হাতে এক মুষ্টি পাথর ছিল। রাসূল (ﷺ) তখন আবু বকর (রাঃ) কে সাথে নিয়ে মসজিদে বসা ছিলেন। সে তাদের উভয়ের কাছে আসলে, আল্লাহ তা‘আলা তার দৃষ্টি থেকে রাসূল (ﷺ) কে আড়াল করে ফেলে। ফলে সে এক মাত্র আবু বকর (রাঃ) ছাড়া আর কাউকে দেখতে পারছিল না। সে বলল, হে আবু বকর! তোমার সাথি কোথায়? আমার নিকট সংবাদ পৌঁছেছে, সে নাকি আমার দুর্নাম করে! আমি শপথ করে বলছি! আজ যদি আমি তাকে পেতাম, তাহলে আমি এ পাথর গুলো তার মাথায় নিক্ষেপ করতাম। একটি কথা মনে রাখবে, আমি একজন কবি এ বলে সে একটি কাব্য বলে,
مُذَممــــــــاً عصينا
وأمره أبينا ودينه قلينا
অর্থ, আমরা মুজাম্মামকে প্রত্যাখ্যান করলাম, তার নির্দেশকে অস্বীকার করলাম এবং তার দ্বীনকে ঘৃণা করলাম।

মুশরিকরা মুসলিমদের উপর সব ধরনের জুলুম নির্যাতন অবিরাম চালিয়ে যেতে লাগল। মুসলিমদের জন্য তাদের জুলুম-নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় অবশিষ্ট রইল না। কিন্তু তাদের জুলুম নির্যাতন সত্ত্বেও মুসলিমদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে লাগল। মুসলিমদের সংখ্যা যত বাড়তে ছিল, তাদের নির্যাতন করার মাত্রাও দিন দিন বাড়তে ছিল। তারা মুসলিমদের উপর জুলুম নির্যাতনের সাথে সাথে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে নানাবিধ অপপ্রচার ও তথ্য সন্ত্রাস চালাত। আল্লাহর হেফাজত ছাড়া তাদের বাচার আর কোন উপায় ছিল না। রাসূল (ﷺ) নিজে আল্লাহর হেফাজতে ছিলেন। তারপর তার চাচা আবু তালেব মক্কায় তাকে নিরাপত্তা দেন; যার কারণে তার নিরাপত্তা নিয়ে তেমন কোন আতংক ছিল না। কিন্তু রাসূলের সাথে যারা ঈমান আনছিল সে সব মুসলিমদের উপর কাফেরদের নির্যাতন কোন ক্রমেই বাধা দিয়ে রাখা যাচ্ছিল না। মুশরিকদের নির্যাতনের ফলে অসহ্য হয়ে অনেকেই মারা যান, আবার কেউ কেউ এমন আছেন, যারা তাদের জুলুম নির্যাতন সহ্য করে কোন রকম বেচে আছেন। মুসলিমদের এহেন নাজুক পরিস্থিতি দেখে রাসূল (ﷺ) তাদের আবিসিনিয়ায় হিজরত করার অনুমতি দেন। রাসূল (ﷺ) এর অনুমতি পেয়ে সর্বপ্রথম বারোজন ছাহাবী চারজন নারী উসমান ইবনে আফ্ফানের নেতৃত্বে আবিসিনিয়ায় প্রথম হিজরত আরম্ভ করেন। তারা যখন সমুদ্রের তীরে পৌঁছলেন, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য দুটি নৌকার ব্যবস্থা করে দেন। এ দুটি নৌকা যোগে তারা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আবিসিনিয়ার মাটিতে পৌঁছেন। এ ঘটনাটি ছিল নবুওয়তের পঞ্চম বছর রজব মাসে। কুরাইশরা মুসলিমদের হিজরতের খবর জানতে পেরে, কোন প্রকার কাল বিলম্ব না করে তাদেরকে ধরার জন্য পিছু নেয় এবং অনুসন্ধানে বের হয়ে পড়ে। তালাশ করতে করতে তারা একেবারে নদীর সন্নিকটে পৌঁছে। কিন্তু তথায় তারা কাউকে পায়নি এবং মুসলিমদের ধরার যে চেষ্টা তারা চালিয়েছিল তা ব্যর্থ হয়। এ দিকে মুসলিমরা নিরাপদে আবিশিনিয়ায় পৌঁছে যায় এবং সেখানে তারা নিরাপদে বসবাস করতে থাকে। কয়েকদিন পর তাদের নিকট খবর পৌঁছল, কুরাইশরা রাসূল (ﷺ) কে এখন আর কষ্ট দেয় না এবং তারা ইসলামের আনুগত্য মেনে নেয়। এ খবর শুনে তারা আবিসিনিয়া থেকে পুনরায় মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। তারা যখন মক্কার নিকট এসে পৌঁছল, তখন জানতে পারল, তাদের নিকট যে খবরটি পৌঁছল, তা ছিল মিথ্যা ও বানোয়াট। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর তারা কেউ কেউ আবার আবিসিনিয়ায় ফিরে গেল আর কেউ কেউ আশ্রয় নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করল। যারা মক্কায় প্রবেশ করল, তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসূদ (রাঃ) ছিল অন্যতম। আবার কেউ কেউ কারো কোন আশ্রয় না নিয়ে গোপনে মক্কায় প্রবেশ করে। এ ঘটনার পর মুসলিমদের উপর কাফেরদের নির্যাতন আরও বৃদ্ধি পেল। যারা মক্কায় প্রবেশ করছে, তাদের প্রতি মুশরিকদের নির্যাতনের মাত্র আরও বাড়িয়ে দিল। অবস্থার অবনতি দেখে রাসূল (ﷺ) দ্বিতীয়বার মুসলিমদের আবিসিনিয়ায় হিজরতের অনুমতি দেন। রাসূল (ﷺ) এর অনুমতি পেয়ে তিরাশি জন মুসলিম যাদের মধ্যে আম্মার ইবনে ইয়াসের ও নয়জন নারী ছিল, তারা সবাই আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। এরা আবিসিনিয়ায় নাজাসী বাদশার অধীনে নিরাপদে বসবাস করতে ছিল। মক্কার মুশরিকরা যখন জানতে পারল, এরা আবিসিনিয়ায় অবস্থান করছে, তখন তারা নাজাসী বাদশার নিকট উপটৌকন দিয়ে মুসলিমদের বিপক্ষে কতক লোক পাঠালেন, তারা তাকে প্রস্তাব দিল, সে যেন মুসলিমদেরকে তার দেশ থেকে বের করে দিয়ে তাদের হাতে ছেড়ে দেয়। নাজ্জাশী বাদশাহ তাদের থেকে বিস্তারিত জানার পর তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং মুসলিমদের তাদের হাতে তুলে দিতে নারাজি প্রকাশ প্রকাশ করেন। বাদশাহ তাদের হাদিয়া গ্রহণ না করে, হাদীয়া তাদের হাতে ফেরত দেন। তারপর মুসলিমরা আবিসিনিয়ায় নিরাপদে অবস্থান করতে থাকেন। কিন্তু খাইবরের তারা বছর রাসূল (ﷺ) এর নিকট আবার ফিরে আসেন। দেখুন: যাদুল মায়াদ ২৩/৩, ৩৬, ৩৮ সীরাতে ইবনে হিশাম ৩৪৩/১, ইমাম যাহবী রহ. এর তারিখুল ইসলাম সীরাত অধ্যায় পৃ: ১৮৩, বিদায়া নিহায়া ৬৬/৩, মাহমুদ শাকের রহ. এর তারিখে ইসলামী ১০৯, ৯৮/২ এবং হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব: পৃ: ১২০, আর-রাহীকুল মাখতুম ৮৯।

 আট:
কুরাইশরা ইসলামের অগ্রযাত্রা, মুসলিমদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়া এবং আবিসিনিয়ায় যারা হিজরত করছে, তাদের প্রতি বাদশাহ নাজাসীর ইতিবাচক মনোভাব, ইজ্জত, সম্মান ও মেহমানদারি দেখে ইসলামের প্রতি তাদের বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা আরও বহুগুণে বেড়ে গেল। তারা নতুন করে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আরম্ভ করে। বনী হাসেম, বনী আব্দুল মুতালেব ও বনী আবদে মুনাফের বিরুদ্ধে তারা বয়কট করার বিষয়ে একমত হয়। তারা ঘোষণা দিল, যতদিন পর্যন্ত মুহাম্মদকে তাদের হাতে তুলে দেয়া না হবে, ততদিন পর্যন্ত তাদের সাথে কোন বেচা-কেনা করবে না, বিবাহ সাধি দেবে না, কোন প্রকার কথা-বার্তা, উঠা-বসা ও লেন-দেন করবে না। তারা এ বিষয়ে একটি চুক্তিনামা তৈরি করে, কাবা ঘরের গিলাফের সাথ ঝুলিয়ে দেয়। একমাত্র আবু লাহাব ছাড়া বনী হাশেম, বনী মুত্তালেবের মুমিন কাফের সবাই এ চুক্তির কারণে নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে যায়। আবু লাহাব রাসূল (ﷺ) বিরুদ্ধে কাফেরদের সহযোগী ছিলেন বলে, তাকে কাফেররা তাদের দলের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। রাসূল (ﷺ) এর নবুওয়ত লাভের সপ্তম বছর মুহাররমের চাঁদে কাফেররা তাকে শুয়াবে আবী তালেবে গৃহবন্দী করে রাখে এবং তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে তারা অতি কষ্টে বন্দীদশায় জীবন যাপন করতে থাকে। প্রায় তিন বছর পর্যন্ত তাদের খাদ্য ও পানীয় সাপ্লাই দেয়া বন্ধ করে দেয়, তাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখে এবং তাদের সাথে যাবতীয় লেন-দেন করা হতে বিরত থাকে। ফলে তাদের কষ্টের আর কোন অন্ত রইল না। সীমাহীন দূর্ভোগের মধ্যে তাদের জীবন যাপন করতে হয়। এমনকি ক্ষুধার জ্বালায় শুয়াবে আবি তালিবের অভ্যন্তর থেকে বাচ্চাদের কান্নাকাটির আওয়াজ ও চিৎকার বাহির থেকে শোনা যেত। এভাবে তিন বছর অতিবাহিত হয়। তারপর আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ﷺ) কে চুক্তিনামা সম্পর্কে জানিয়ে দেন যে, একটি উই পোকা পাঠানো হয়েছে, সে একমাত্র আল্লাহর নাম ছাড়া আর যে সব শর্তাবলী তাতে লেখা ছিল, তা সবই খেয়ে ফেলছে।

রাসূল (ﷺ) তার চাচা আবু তালিবকে বিষয়টি জানালে, তিনি কুরাইশদের নিকট গিয়ে বললেন, মুহাম্মাদ (ﷺ) বলছে, তোমাদের চুক্তি নামায় একমাত্র আল্লাহর নামের অংশ ছাড়া বাকী সবটুকু অংশ পোকা খেয়ে ফেলছে। যদি সে তার কথায় মিথ্যুক হয়, আমি তাকে তোমাদের সোপর্দ করে দেব। আর যদি সত্যবাদী হয়, তাহলে তোমরা আমাদের সাথে যে চুক্তি করছ, তা হতে ফিরে আসবে এবং আমাদের উপর জুলুম অত্যাচার করা হতে বিরত থাকবে। তারা সবাই সমস্বরে বলল, তুমি একটি ইনসাফ-পূর্ণ কথা বলেছে! তারপর তারা চুক্তিনামাটি নামাল এবং রাসূল (ﷺ) যেভাবে সংবাদ দিলেন, ঠিক সেভাবেই দেখতে পেল। এ ঘটনার পর তারা চুক্তি হতে ফিরে আসা-তো দূরের কথা, বরং তাদের কুফরি আরো বৃদ্ধি পেল। নবুওয়ত লাভের দশ বছর পর, রাসূল (ﷺ) ও তার সাথীরা শুয়াবে আবু তালেবের বন্দীশালা থেকে বের হন। এ ঘটনার মাত্র ছয় মাস পর আবু তালেব দুনিয়া থেকে চির বিদায় নেয়। আবু তালেবের মৃত্যুর তিনদিন পর (ﷺ) এর সহধর্মী-নি খাদীজা (রাঃ) ইন্তেকাল করেন। সীরাতে ইবনে হিশাম ৩৭১/১, ইমাম যাহবী রহ. এর তারিখুল ইসলাম সীরাত অধ্যায় পৃ: ১২৬, ১৩৭, বিদায়া নিহায়া ৬৪/৩, যাদুল মায়াদ ৩০/৩, , মাহমুদ শাকের রহ. এর তারিখে ইসলামী ১০৯/২ এবং রাহীকুল মাখতুম পৃ: ১১২।

চুক্তি ভঙ্গ হওয়ার পর, সামান্য সময়ের ব্যবধানে রাসূল (ﷺ) এর দুই সহযোগী আবু তালিব ও খাদীজা (রাঃ) এর ইন্তেকাল হয়। তাদের উভয়ের ইন্তেকালে রাসূল (ﷺ) এর অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়। মুশরিকরা তাদের ইন্তেকালকে তাদের জন্য সুযোগ হিসেবে কাজে লাগায়। মুশরিকদের পক্ষ হতে রাসূল (ﷺ) ও মুসলিমদের উপর নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যায় এবং তাদের দু:সাহস সীমা ছড়িয়ে যায়। তাদের ইন্তেকালের পর সগোত্রের কাফেরদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে, রাসূল (ﷺ) তায়েফের অধিবাসীরা তার দাওয়াতে সাড়া দেবে, তার কাওমের বিরুদ্ধে তাকে সাহায্য করবে অথবা তাকে আশ্রয় দেবে এ আশা নিয়ে তায়েফ গমনের সংকল্প করেন। কিন্তু আশা আশাই থাকল, বাস্তবায়ন হল না। সেখানে তিনি কোন সাহায্যকারী কিংবা আশ্রয়দাতা ও ইসলাম গ্রহণকারী না পেয়ে সেখান থেকেও হতাশ হয়ে আবারো মক্কায় ফিরে আসেন। রাসূল (ﷺ) তায়েফে তায়েফের অধিবাসীদের থেকে এমন জুলুম নির্যাতনের সম্মুখীন হন, যা মক্কার কাফেরদের জুলুম নির্যাতনকেও হার মানিয়ে দেয়। যাদুল মায়াদ: ৩১/৩, রাহীকুল মাখতুম পৃ: ১১৩।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ:
তায়েফ গমনের পর রাসূল (ﷺ) এর দাওয়াতি কার্যক্রমের অবস্থা:
নবুওয়তের দশম বছর রাসূল (ﷺ) একরাশ আশা ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তায়েফ গমন করেন। তিনি আশা করছিলেন, সাকীফের লোকেরা হয়ত তার দাওয়াত কবুল করবে এবং তাকে সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে। তাই স্বীয় গোলাম যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ) সাথে নিয়ে রাসূল (ﷺ) তায়েফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। পথিমধ্যে তিনি যত লোকের সাথে অতিক্রম করেন, প্রত্যেককে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনার আহ্বান করেন। কিন্তু অত্যন্ত দু:খের বিষয় হল, একজন লোকও তার ডাকে সাড়া দেয়নি এবং ইসলাম কবুল করেনি।

 এক. তায়েফ বাসীদের দাওয়াত দিতে গিয়ে রাসূল (ﷺ) এর হিক্মাহ্ ও বুদ্ধিমত্তা:
রাসূল (ﷺ) তায়েফে পৌঁছে, প্রথমে তায়েফের সরদারদের ইসলামের দাওয়াত দেন। তিনি প্রথমে তাদের নিকট গিয়ে তাদের সাথে বসেন এবং তাদের সাথে কথাবার্তা ও বিভিন্নি ধরনের আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তাদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। তারপর তাদের তিনি ইসলাম কবুল করার দাওয়াত দেন। তারা তার দাওয়াতে কোন প্রকার সাড়া না দিয়ে ইসলামের দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু রাসূল (ﷺ) তাদের বিষয়ে কোন প্রকার হতাশ না হয়ে, তার দাওয়াত চালিয়ে যান। রাসূল (ﷺ) তায়েফে টানা দশদিন অবস্থান করেন। তায়েফে তিনি তার সব চেষ্টা ও কৌশল ব্যয় করেন। কিন্তু একজন লোকও ইসলাম কবুল করল না, তারা শুধু রাসূল (ﷺ) এর নিকট আসল, আর তার সাথে কথা বলে চলে গেল এবং তারা আল্লাহর নবীকে তাড়াতাড়ি এ এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলল। তারা তায়েফের ছোট ছোট বাচ্চা ও খারাব লোকদেরকে তার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে এবং তাকে কষ্ট দেয়ার জন্য তার পিছনে লেলিয়ে দেয়। রাসূল (ﷺ) যখন বুঝতে পারল, তায়েফের লোকেরা আর ঈমান আনবে না, তখন সে তায়েফ থেকে বের হয়ে চলে আসতে ছিল। কিন্তু কাফের বেঈমানরা তখনো রাসূল (ﷺ) এর উপর জুলুম-নির্যাতন চালানো বন্ধ করেনি। তারা তাদের গোত্রের লোকদের দুটি কাতারে বিভক্ত করে রাস্তার দু পাশে দাড় করিয়ে দেয় এবং রাসূল (ﷺ) বের হওয়ার সময় সারিবদ্ধ হয়ে তাকে গালি দিতে থাকে এবং তার উপর বৃষ্টির মত পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। পাথরের আঘাতে রাসূল (ﷺ) এর পবিত্র দেহ রক্তাক্ত হয়ে পড়ে। তার শরীর থেকে রক্ত প্রবাহিত হয়ে, তা পা পর্যন্ত গড়ায়। ফলে তার জুতা-দ্বয় রক্তে রঞ্জিত হয়ে লাল হয়ে যায় এবং তার জুতার মধ্যে রক্তের জমাট বেধে যায়। যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ) যিনি রাসূল (ﷺ) এর সাথী ছিলেন, জীবন বাজি দিয়ে সে দিন রাসূল (ﷺ) থেকে পাথরের আঘাতকে প্রতিহত করছিল। আল্লাহর নবীকে বাঁচানোর জন্য তিনি নিজেকে ডাল হিসেবে ব্যবহার করল। যার কারণে তাদের নিক্ষিপ্ত পাথর তার মাথায় চরম আঘাত হানে এবং সেও রক্তাক্ত হয়। রাসূল (ﷺ) তায়েফ থেকে দু:খ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে পুনরায় মক্কায় ফিরে আসেন। মক্কার পথে আল্লাহ তা‘আলা জিবরীল (আঃ) কে পাহাড়ের ফেরেশতাসহ রাসূল (ﷺ) এর নিকট পাঠান, সে রাসূল (ﷺ) এর নিকট অনুমতি চেয়ে বলল, আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমরা আপনাকে যে রক্তাক্ত করছে, তার বদলা নেই। আপনি বললে, দুই পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত মক্কাবাসীদের পাহাড়-দ্বয় দ্বারা নিষ্পেষিত করে দেই। কিন্তু দয়ার নবী তাদের প্রস্তাবে সম্মতি দেননি এবং তাদের ধ্বংস করার অনুমতি দেননি। যাদুল মায়াদ: ৩১/৩, রাহীকুল মাখতুম: পৃ: ১২২, বিদায়া নিহায়া: ১৩৫/৩, হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব: পৃ: ১৩২, রাহীকুল মাখতুম পৃ: ১২২।

 দুই. পাহাড়ের ফেরেশতাকে রাসূল (ﷺ) এর হিকমত-পূর্ণ ও জ্ঞানগর্ভ উত্তর:
আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি একদিন রাসূল (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসূল! ওহুদের যুদ্ধের দিন আপনার উপর যে বিপর্যয় নেমে আসে, তার চেয়ে কঠিন আর কোন বিপদ বা বিপর্যয় আপনার উপর নেমে আসছিল কি? তিনি বলেন, আমার উপর এর চেয়ে আরও অধিক কঠিন বিপদ ও বিপর্যয় নেমে আসে আকাবার দিন। সে দিন আমি একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হই। যখন আমি আমাকে ইসলামের দাওয়াতের জন্য আবদে ইয়ালিল বিন আবদে কালাল (আবদে ইয়ালাল ইবনে কালাল হল, সাকীফ গোত্রের বড় বড় সরদারগণ। ) এর সম্মুখে পেশ করি, তখন তারা আমার ডাকে সাড়াতো দেয়নি, বরং আমাকে অকথ্য ভাষায় ঘালি গালাজ করে এবং আমাকে অপমান করে। আর যখন আমি তাদের থেকে হতাশ হয়ে দু:খ্য -ভারাক্রান্ত হৃদয় মক্কার দিকে ফিরে আসি, তখন আমার কোন হুশ ছিল না, কারনুস সায়ালেব(এটি একটি স্থানের নাম। আহলে নাজদের লোকদের হজের মিকাতের স্থান। এ জায়গাটিকে কারনুল মানাযেল ও বলা হয়ে থাকে। বর্তমানে তাকে সাইলুল কবীর নামে আখ্যায়িত করা হয়। আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন ফতহুল কাদির: ১১৫/৬।) এসে পৌঁছই, তখন আমার হুশ হয়। তখন আমি আকাশের দিকে মাথা উঁচা করে দেখি একটি কালা মেঘ এসে আমাকে ছায়া দেয়। তাতে তাকিয়ে দেখি তার মধ্যে জিবরীল (আঃ) অবস্থান করছে। সে আমাকে ডেকে বলে, আল্লাহ তা‘আলা তোমার কওমের কথা এবং তোমার সাথে তারা যে ব্যবহার করছে তা শুনেছে। আল্লাহ তা‘আলা পাহাড়ের ফেরেশতাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছে, যাতে আপনি তাদের বিষয়ে যা সিদ্ধান্ত দেন, তারা তাই করবে। তারপর পাহাড়ের ফেরেশতা আমাকে সালাম দেয় এবং বলে, হে মুহাম্মদ! আল্লাহ তা‘আলা তোমার ও তোমার কাওমের কথা খুব ভালোভাবেই শোনেন। আমি হলাম পাহাড় নিয়ন্ত্রণকারী ফেরেশতা! আমাকে আমার রব আপনার নিকট পাঠিয়েছেন, আপনি আমাকে যা আদেশ করেন তাই আমি বাস্তবায়ন করব। আপনি যদি চান আমি তাদেরকে উভয় পাহাড় দ্বারা চাপা দিয়ে তাদের নিষ্পেষিত করে দেই। এ প্রস্তাবের উত্তরে রাসূল (ﷺ) বললেন, না, তুমি তাদরে ধ্বংস করো না! কারণ, হতে পারে আল্লাহ তা‘আলা তাদের বংশধর হতে এমন লোকদের সৃষ্টি করবেন, যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে তার সাথে কাউকে শরীক করবে না। (বুখারি অধ্যায়: মাখলুকের সৃষ্টির সূচনা, পরিচ্ছেদ: তোমাদের কেউ যখন বলে আমীন, আসমানের ফেরেস্তাও আমীন বলে। যখন তোমাদের আমীন ফেরেস্তাদের আমীন বলার সাথে মিলে যায় তখন তার অতীতের সমস্ত গুণাহ মাফ হয়ে যায়। ৩১২/৬। মুসলিম একই শব্দে কিতাবুল জিহাদে। পরিচ্ছেদ: রাসূল (ﷺ) মুনাফেক ও মুশরিকদের পক্ষ থেকে যে সব নির্যাতনের স্বীকার হন তার বর্ণনা প্রসংঙ্গে। ৩২১/৬ হাদীস নং ৩২৩১।)
عن عائشة ’ أنها قالت لرسول اللَّه صلى الله عليه وسلم: يا رسول اللَّه هل أتى عليك يوم أشد من يوم أحد؟ فقال: ((لقد لقيت من قومك [ما لقيت]، وكان أشد ما لقيت منهم يوم العقبة، إذ عرضت نفسي على ابن عبد ياليل بن عبد كلال، فلم يجبني إلى ما أردت، فانطلقت وأنا مهموم على وجهي، فلم أسْتَفِق إلا بقرن الثعالب، فرفعت رأسي، فإذا أنا بسحابة قد أظلتني، فنظرت فإذا فيها جبريل، فناداني: فقال: إن اللَّه  قد سمع قول قومك لك، وما ردوا عليك، وقد بعث إليك ملك الجبال لتأمره بما شئت فيهم، قال: فناداني ملك الجبال وسلم عليّ، ثم قال: يا محمد! إن اللَّه قد سمع قول قومك لك، وأنا ملك الجبال، وقد بعثني ربي إليك لتأمرني بأمرك فما شئت؟ إن شئت أن أُطْبِق عليهم الأخشبين)). فقال لـه رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم: ((بل أرجو أن يخرج اللَّه من أصلابهم من يعبد اللَّه وحده لا يشرك به شيئاً)).
রাসূল (ﷺ) তাদের যে উত্তর দেন, তাতে তিনি যে কত বড় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তা স্পষ্ট হয়, তার মহান ব্যক্তিত্বের পরিচয় ফুটে উঠে এবং আল্লাহ তা‘আলা যে, তাকে মহা চরিত্রের অধিকারী করেন, এ উত্তর ছিল তার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ। এছাড়া এখানে রাসূল (ﷺ) তার স্বজাতিদের প্রতি কতটা আন্তরিক, ধৈর্যশীল ও সহমর্মী তার বাস্তবতা উজ্জ্বল হয়ে উঠে। আল্লাহ তা‘আলা তার সমর্থনে বলেন,
﴿فَبِمَا رَحۡمَة مِّنَ ٱللَّهِ لِنتَ لَهُمۡۖ﴾ [آل عمران:159]
আল্লাহর অপার অনুগ্রহে তুমি তাদের সাথে নমনীয়তা প্রদর্শন কর। সূরা আল-ইমরাম আয়াত ১৫৯।

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا رَحۡمَة لِّلۡعَٰلَمِينَ﴾ [الأنباء:107]
অর্থ, আমি তোমাকে জগতের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি। সূরা: আম্বিয়া আয়াত: ১০৭
আল্লাহ তা‘আলার রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক তার উপর। দেখুন: ইবনুল কাইয়েম রহ. এর যাদুল মায়াদ ৩৩/৩.

রাসূল (ﷺ) নখলাতে কয়েকদিন অপেক্ষা করেন। তারপর তিনি পুনরায় মক্কায় ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা করেন। মক্কায় তিনি নতুনভাবে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত এবং আল্লাহর পক্ষ হতে অর্পিত রিস্বলাতের গুরু দায়িত্ব পৌছানোর উদ্দেশ্যে নতুন আঙ্গিকে কাজ করা প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তার এ সংকল্পেরে কথা ব্যক্ত করার পর যায়েদ ইবনে হারেসা তাকে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আবার কীভাবে মক্কায় প্রবেশ করবেন? অথচ তারা আপনাকে মক্কা হতে বের করে দিয়েছে। তারপর রাসূল (ﷺ) তাকে বলেন , দেখুন: ইবনুল কাইয়েম রহ. এর যাদুল মায়াদ ৩৩/৩.
أنه قال: ((يا زيد، إن اللَّه جاعل لما ترى فرجاً ومخرجاً، وإن اللَّه ناصر دينه، ومظهر نبيه)).
অর্থ, হে যায়েদ! আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই তুমি যে অবস্থা দেখছ, তার একটি সমাধান এবং উপায় বের করবে। আল্লাহ তা‘আলা তার দ্বীনকে অবশ্যই সাহায্য করবে এবং তার নবীকে বিজয়ী করবে।

 তিন. মক্কায় প্রবেশে হিকমত অবলম্বন:
তায়েফ থেকে রাসূল (ﷺ) মক্কার দিকে রওয়ানা দেন এবং মক্কার নিকটে এসে তিনি মুতয়েম ইবনে আদীর নিকট তাকে আশ্রয় দেয়ার প্রস্তাব দিয়ে একজন লোক পাঠান। মুতয়েম প্রস্তাব পেয়ে বলল, ঠিক আছে, আমি তাকে আশ্রয় দেব। সে তার ছেলে- সন্তান ও কওমের লোকদের ডেকে বলল, তোমরা মুহাম্মাদ (ﷺ) এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অস্র-শস্র নিয়ে বায়তুল্লাহর নিকট অবস্থান নাও; আমি মুহাম্মদ (ﷺ) কে আশ্রয় দিয়েছি। তারপর রাসূল (ﷺ) যায়েদ ইবনে হারেসাকে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন, মসজিদে হারামের নিকট পৌছলে মুতয়েম ইবনে আদী তার আরোহণের উপর দাড়িয়ে ঘোষণা দেন, হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমি মুহাম্মদ (ﷺ) কে আশ্রয় দিয়েছি। সুতরাং, তোমরা কেউ তাকে অপমান করতে পারবে না কোন প্রকার মারধর করতে পারবে না। রাসূল (ﷺ) মক্কায় প্রবেশ করার পর রোকনে ইয়ামনিকে স্পর্শ করেন এবং দুই রাকাত স্বলাত আদায় করেন। তারপর মুতয়েম ইবনে আদী ও তার ছেলেদের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে তার ঘরে ফিরে যান। যাদুল মায়াদ: ৩৩/৩, রাহীকুল মাখতুম পৃ: ১২৫, , বিদায়া নিহায়া ১৩৭/৩, রাহীকুল মাখতুম পৃ: ১২২।

রাসূল (ﷺ) তায়েফ থেকে ফিরে এসে মক্কায় দ্বিতীয়বার প্রবেশ, তাদের ইসলামের দিকে দাওয়াত দেয়ার বিষয়ে তার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা এবং মানুষ তার ডাকে সাড়া না দেয়াতে তার নৈরাশ না হওয়া স্পষ্ট প্রমাণ করে, তিনি যে কত বড় প্রত্যয়ী, মহান ও সাহসী ছিলেন। তায়েফের অধিবাসীদের দাওয়াত দিতে গিয়ে তার সব কৌশল ফেল হওয়ার পরও, তিনি দাওয়াতের জন্য আবারো নতুন কৌশলের সন্ধান করতে থাকে। কীভাবে মানুষকে আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করা যায় এ চিন্তায় তিনি ছিলে সব সময় বিভোর।

এতে এ কথা দিবালোকের মতে স্পষ্ট হয়, রাসূল (ﷺ) দাওয়াতের ক্ষেত্রে যত রকম কৌশল অবলম্বন করেন, একজন দা‘ঈর জন্য এগুলোই হল, অনুকরণীয় আদর্শ। কারণ, তিনি হলেন, সব কিছুর ওস্তাদ; তার চেয়ে বড় দা‘ঈ আর কেউ কোন দিন হতে পারবে না। তিনি যখন তায়েফে গমন করেন, প্রথমে তিনি তায়েফের বড় বড় নেতাদের ইসলামের দাওয়াত দেন। কারণ, তিনি জানতেন বড় বড় নেতারা যখন ইসলামে প্রবেশ করবে, তখন অবশিষ্ট গোত্রের লোকেরা তাদের দেখে দেখে অতি সহজেই ইসলাম গ্রহণ করবে।

রাসূল (ﷺ) এর রক্তাক্ত হওয়া প্রমাণ করে যারাই মানুষকে আল্লাহর পথের দাওয়াত দিবে, তাদের অবশ্যই বিপদের সম্মুখীন এবং নির্যাতনের স্বীকার হতে হবে। যত বড় হিকমতই অবলম্বন করুক না কেন, তাদেরকে অবশ্যই ঈমানের পরীক্ষা দিতে হবে।

আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে জগত বাসীর জন্য রহমত হিসেবেই পাঠান। এ কারণেই রাসূল (ﷺ) এর উপর কাফেরদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের অমানবিক ও অমানুষিক নির্যাতন স্বত্বেও তার কওমের লোকের বিরুদ্ধে তিনি কোন প্রকার বদ-দোয়া করেনি ও তাদের অভিশাপ করেননি। পাহাড়ের নিয়ন্ত্রক ফেরেশতা যখন তাদের নিষ্পেষিত বা ধ্বংস করে দিতে চাইল, তাতেও তিনি রাজি হননি। একজন দা‘ঈর জন্য রাসূল (ﷺ) এর আদর্শ থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে। দেখুন! যারা তার দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করল, তাদের হেদায়েতের ব্যাপারে তিনি কখনোই হতাশ হননি। বরং তিনি আশা করেন, তারা যদিও আমার দাওয়াত গ্রহণ করেনি, কিন্তু হতে পারে তাদের বংশের মধ্যে এমন এক প্রজন্মের আভির্বাব হবে, যারা আমার এ দাওয়াতের উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে, আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে এবং আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না।

রাসূল (ﷺ) তায়েফ হতে মক্কায় ফিরে আসার ঘটনায় আমরা আরও অনেক বুদ্ধিমত্তা ও হিকমত দেখতে পাই, তা হল, তিনি মুতয়েম ইবনে আদীর নিরাপত্তা নিয়েই মক্কায় প্রবেশ করেন; একা একা প্রবেশ করেননি। তিনি ইচ্ছা করলে হঠকারিতা অবলম্বন করতে পারত। দু:শাহস দেখিয়ে হুট করে প্রবেশ করতে পারত; কিন্তু তিনি তা করেননি, বরং তিনি একটি নিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন। সুতরাং একজন দা‘ঈর জন্য জরুরি হল, সে তার দাওয়াতি ময়দানে এমন লোককে খুঁজবে, যে তাকে তার দুশমনদের আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র হতে রক্ষা করবে এবং কোন প্রকার হঠকারিতা দেখাবে না। কারণ, হ কারি সিদ্ধান্তের কারণে একজন দা‘ঈ তার অভীষ্ট লক্ষে পৌছতে পারে না। অভীষ্ট লক্ষে পৌছতে হলে, তাকে অবশ্যই নিয়মের আওতায় আসতে হবে।দেখুন: মুস্তফা আস সাবায়ীর সীরাতে নববী দুরুস ও উপদেশ পৃ: ৫৮। যাদুল মায়াদ ৩১/৩, রাহীকুলা মাখতুম পৃ: ১২২, বিদায়া নিহায়া ১৩৫/৩, হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব পৃ: ১৩২, রাহীকুল মাখতুম পৃ: ১২২।

 চার. বাজার-ঘাট ও লোকসমাগম স্থান ও বিভিন্ন মৌসুমে রাসূল (ﷺ) এর দাওয়াত:
নবুওয়তের দশম বছর রাসূল (ﷺ) তায়েফ থেকে ফিরে এসে মক্কায় আবারো ইসলামের দাওয়াত দিতে আরম্ভ করেন। তিনি সব সময় এবং সব জায়গায় মানুষকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেয়ার কাজে লিপ্ত থাকেন। হাট, বাজার, রাস্তা, ঘাট সব জায়গায় তিনি ইসলামের দাওয়াত চালিয়ে যেতেন। যেখানে যেখানে বাজার বসত সেখানে গিয়ে তিনি লোকদের দাওয়াত দিতেন। জাহিলিয়্যাতের যুগে উকাজ, মাজনা ও জি-মাজায নামে বিভিন্ন বাজার ছিল। লোকেরা এখানে সপ্তাহে একবার বা দুইবার একত্র হত। এ ছাড়া ও আরবরা তাদের ব্যবসা বাণিজ্য, গান-বাজনা ইত্যাদির অনুষ্ঠান করার জন্য এ সব বাজারগুলোতে একত্র হত। রাসূল (ﷺ) সেখানে গিয়ে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন এবং তাদের আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার আহ্বান করতেন। বিশেষ করে হজের মওসুম আসলে, আরবের বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা মক্কায় একত্র হত। রাসূল (ﷺ) এ সুযোগটাকে কাজে লাগাতেন। রাসূল (ﷺ) প্রতিটি গোত্রের নিকট আলাদা আলাদা করে যেতেন এবং তাদের তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতেন। শুধু গোত্রের লোকদের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিয়ে রাসূল (ﷺ) ক্ষান্ত হননি, তিনি একজন একজন করে প্রতিটি লোককে তার দাওয়াত পৌছিয়ে দেন। রাসূল (ﷺ) সব সময় মানুষকে কল্যাণের প্রতি আহবান করেন এবং ভালো কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান করতেন। আব্দুর রহমান ইবনে আবিয যানাদ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, বনী দাইল গোত্রের রাবীয়া ইবনে উব্বাদ নামে একজন মূর্খ লোক আমাকে জানান যে, আমি জাহিলিয়্যাতের যুগে জিল-মাযাজ বাজারে রাসূল (ﷺ) কে দেখি, সে সমবেত লোকদের বলছে, হে মানুষ সকল! তোমরা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বল ((يا أيها الناس قولوا لا إله إلا اللَّه تفلحوا)) তোমারা অবশ্যই সফল হবে। রাসূল (ﷺ) এর পিছনে পিছনে বিবর্ণ চেহারার একজন লোক লেগে ছিল, সে লোকদের বলছে, লোকটি ধর্মত্যাগী, মিথ্যুক। তোমরা তার কথা শোনো না। রাসূল (ﷺ) যেখানেই যেত, লোকটি তার সাথে সাথে থাকত, এবং এ কথা বলে বেড়াত। আমি উপস্থিত লোকদের জিজ্ঞাসা করলাম লোকটি কে? লোকেরা বলল, রাসূল (ﷺ) চাচা আবু লাহাব।আহমদ: ৪৯২/৩, ৩৪১/৪, হাদীসটির সনদ হাসান। একই সনদের পক্ষে সাহেদ আছে।

আওস ও খাজরাজের লোকেরাও আরবদের মত হজ পালন করার উদ্দেশ্যে মক্কায় আসত। আনছারীরা রাসূল (ﷺ) এর অবস্থা ও তার গুণাগুণ দেখে বুঝতে পারল, এ হল, সে নবী যার প্রতিশ্রুতি ইয়াহু-দীরা আমাদেরকে সুদীর্ঘ কাল পর্যন্ত দিয়ে আসছিল। যার কারণে তারা চাইত তার নিকট গিয়ে তারাই আগে আগে ইসলাম গ্রহণ করবে। কিন্তু তারা অজ্ঞাত কারণে এ বছর ইসলাম গ্রহণ করল না এবং মদিনায় ফিরে গেল। যাদুল মায়াদ ৪৩/৩, ৪৪, তারীখে ইসলামী ১৩৬/২, রাহীকুল মাখতুম পৃ: ১২৯, বিদায়া নিহায়া ১৪৯/৩, ইবনে হিশাম ৩১/২।

নবুওয়তের এগারতম বছর রাসূল (ﷺ) বিভিন্ন গোত্রের লোকদের সাথে আলাদা আলাদা বসে তাদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। রাসূল (ﷺ) একদিন আকাবায়ে মিনা দিয়ে অতিক্রম করছিল, তখন তার সাথে ইয়াসরবের ছয়জন যুবকের সাথে দেখা হয়, তাদের দেখে রাসূল (ﷺ) কাল বিলম্ব না করে তাদের মধ্যে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। রাসূল (ﷺ) এর দাওয়াত পেয়ে তারা ইসলামের দাওয়াতে সাড়া দেয় এবং তার রিস্বলাতের উপর ঈমান আনে। তারা নিজেরা ইসলাম কবুল করার পর, তারা ইসলামের দাওয়াতের দায়িত্ব নিয়ে তাদের নিজেদের কওমের নিকট ফিরে যায়। তাদের দাওয়াতের বদৌলতে আনছারদের প্রতিটি ঘরে ঘরে রাসূল (ﷺ) ও তার দাওয়াদের আলোচনা পৌঁছে যায়। যাদুল মায়াদ: ৪৫/৩, সীরাতে ইবনে হিশাম: ৩৮/২, বিদায়া নিহায়া ১৪৯/৩, মাহমুদ শাকের রহ. এর তারিখে ইসলামী ১৩৭/২ এবং হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব পৃ ১৪৫/২ রাহীকুল মাখতুম পৃ: ১৩২।

পরবর্তী বছর ছিল- নবুওয়তের বারতম বছর- বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ আবারো হজের উদ্দেশ্যে মক্কায় আগমন করে। ঐ বছর যারা হজের উদ্দেশ্যে মক্কায় গমন করে, তাদের মধ্যে বারোজন আনছারী যুবক ছিল। তাদের পাঁচজন হল বিগত বছর যারা রাসূল (ﷺ) এর সাক্ষাত করেছিল তারা, আর বাকীরা হল নতুন। তারা সবাই তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মিনায় আকাবার নিকট মিলিত হয় এবং সবাই ইসলাম গ্রহণ করে। ইসলাম গ্রহণের পর তারা রাসূল (ﷺ) হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে। যাদুল মায়াদ ৪৬, ৪৪/৩, সীরাতে ইবনে হিশাম ৩৮/২, বিদায়া নিহায়া ১৪৯/৩, মাহমুদ শাকের রহ. এর তারিখে ইসলামী ১৩৯/২ এবং হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব পৃ ১৪৫ রাহীকুল মাখতুম পৃ: ১৩৯।
عن عبادة بن الصامت أن رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم قال وحوله عصابة من أصحابه: ((تعالوا بايعوني على أن لا تشركوا باللَّه شيئاً، ولا تسرقوا، ولا تزنوا، ولا تقتلوا أولادكم، ولا تأتوا ببهتانٍ تفترونه بين أيديكم وأرجلكم، ولا تعصوني في معروفٍ، فمن وفى منكم فأجره على اللَّه، ومن أصاب من ذلك شيئاً فعوقب به في الدنيا فهو لـه كفارة، ومن أصاب من ذلك شيئاً فستره اللَّه عليه فأمره إلى اللَّه: إن شاء عاقبه، وإن شاء عفا عنه)) فبايعناه على ذلك. »
উবাদা ইবনে সামেত (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসূল (ﷺ) এর আশ পাশে এক জামাত ছাহাবী বসা ছিল, তখন তিনি সবাইকে বললেন, আসো তোমরা আমার হাতে এ কথার উপর বাইয়াত গ্রহণ কর যে, তোমরা আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না, চুরি করবে না ব্যভিচার করবে না, তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না এবং কাউকে সরাসরি অপবাদ দিবে না। কোন ভালো কাজের নির্দেশ দিলে তাতে তোমরা আমার অবাধ্য হবে না। তোমাদের মধ্য হতে যে আমার সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি পালন করবে, তার বিনিময় আল্লাহর নিকট অবধারিত। আর যে আমার নির্দেশ অমান্য করবে এবং তার জন্য তাকে দুনিয়াতে শাস্তি দেয়া হয়, তাহলে তা তার জন্য কাফ্ফরা স্বরূপ। আর যদি কেউ কোন অপরাধ করে এবং আল্লাহ তা‘আলা তা গোপন রাখে, তার বিষয়টি আল্লাহর নিকট সোপর্দ। আল্লাহ যদি চায়, তাকে শাস্তি দেবে আর যদি চান, তিনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন। আমরা সমবেত সবাই রাসূল (ﷺ) এর হাতে এর উপর বাইয়াত গ্রহণ করি। বুখারী অধ্যায়: মানাকেবুল আনছার, পরিচ্ছেদ মক্কায় আনছারীদের নবী করীম (ﷺ) এর নিকট আগমন: ২১৯/৭, ৩৮৯২। কিতাবুল ঈমান পরিচ্ছেদ: আমাদের হাদীস বর্ণনা করেন আবুল আইমান (১৮)।

রাসূল (ﷺ) এর হাতে বাইয়াত শেষ হওয়ার পর যখন আমরা হজ পালন করে মক্কা হতে মদিনার দিকে রওয়ানা দিই, তখন রাসূল (ﷺ) মুসআব ইবনে উমাইর (রাঃ) কে আমাদের সাথে পাঠান; যাতে সে আমাদেরকে ইসলামের আহকাম শিখান এবং আমাদের মধ্যে ইসলামের দাওয়াত দেন। মুসআব ইবনে উমাইর (রাঃ) তার উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করেন। যার ফলে পরবর্তী বছর অর্থাৎ নুবওয়তের তেরতম বছরে ইয়াসরেব থেকে ৭৩ জন পুরুষ ও দুইজন মহিলা হজ পালন করতে মক্কায় আসে এবং তাদের সবাই ইসলাম গ্রহণ করে। এরা মক্কায় গমনের পূর্বেই মক্কায় এসে আকাবায় রাসূল (ﷺ) এর সাথে সাক্ষাতের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তারা তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মক্কায় উপস্থিত হয়ে, রাসূল (ﷺ) এর সাথে সাক্ষাত করে এবং তার সাথে কথা-বার্তা বলে। তারা রাসূল (ﷺ) কে বলে, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনার হাতে কিসের উপর বাইয়াত গ্রহণ করব? তখন রাসূল (ﷺ) তাদের বললেন,
((تبايعوني على: السمع والطاعة في النشاط والكسل، والنفقة في العسر واليسر، وعلى الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر، وأن تقولوا في اللَّه لا تخافون لومة لائم، وعلى أن تنصروني فتمنعوني إذا قدمت عليكم ما تمنعون منه أنفسكم وأزواجكم وأبناءكم ولكم الجنة)) ،فقاموا إليه فبايعوه. »
অর্থ, তোমরা সচ্ছল ও অসচ্ছল, ব্যস্ত ও অবসর সর্বাবস্থায় আমার কথা শুনবে এবং মানবে এ কথার উপর আমার হাতে বাইয়াত কর। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে মানুষকে বারণ করবে এ বিষয়ের উপর বাইয়াত গ্রহণ কর। আর তোমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হও, তোমরা আল্লাহর বিষয়ে কোন সত্য কথা বলতে কোন নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবে না। আর আমি যখন তোমাদের নিকট পৌছব, তখন তোমরা আমার সাহায্য করবে। আমার থেকে যে কোন নির্যাতন ও জুলুম তোমরা প্রতিহত করবে। যেমনটি তোমরা তোমাদের নিজেদের স্ত্রী সন্তান ও তোমাদের মাতা -পিতা হতে প্রতিহত করে থাক। আর এ সবের বিনিময়ে তোমরা লাভ করবে জান্নাত। (মুসনাদে আহমাদ: ৩২২/৩, বাইহাকী ৯/৯, হাকেম হাদীসটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন।) তারপর তারা সবাই তার দিকে অগ্রসর হয়ে তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে।

এ বাইয়াত শেষ হওয়ার পর রাসূল (ﷺ) তাদের মধ্যে হতে বারো জনকে তাদের নেতা বানিয়ে দেন। তারা প্রত্যেকেই তাদের সম্প্রদায়ের লোকদের ইসলামের দাওয়াত দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এদের মধ্যে নয়জন ছিল খাজরাজ গোত্রের আর তিনজন ছিলেন আওস গোত্রের। তারপর তারা ইয়াসরবে ফিরে এসে, তাদের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়। আল্লাহ তা‘আলা তাদের মাধ্যমেই ইসলামের দাওয়াতকে আরও সু-সংঘটিত করেন। যাদুল মায়াদ ৪৫/৩, সীরাতে ইবনে হিশাম ৪৯/২, বিদায়া নিহায়া ১৫৮/৩, মাহমুদ শাকের রহ. এর তারিখে ইসলামী ১৪২/২ এবং রাহীকুল মাখতুম পৃ: ১৪৩।

আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াত সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে রাসূল (ﷺ) দ্বীনের দাওয়াতের ক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে গেলেন। ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য একটি দারুল ইসলাম বা ইসলামের আবাস ভূমি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেন। এ খবরটি মক্কায় ছড়িয়ে পড়লে মক্কার কাফেরদের ক্ষোভ আরও বেড়ে গেল এবং তারা মুসলিমদের উপর তাদের নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল। তাদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে রাসূল (ﷺ) সাহাবীদের মদিনায় হিজরত করার নির্দেশ দেন। রাসূল (ﷺ) এর নির্দেশে অনেক মুসলিমরা মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে। শেষ পর্যন্ত রাসূল (ﷺ) নিজেও মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হন। নবুওয়তের চৌদ্দতম বছর সফর মাসের ২৬ তারিখে কুরাইশরা রাসূল (ﷺ) কে হত্যা করার বিষয়ে একমত হলে, আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ﷺ) ওয়াহ্‌য়ীর মাধ্যমে মদিনায় হিজরত করার নির্দেশ দেন। রাসূল (ﷺ) অত্যন্ত সুকৌশলে কাফেরদের চোখকে ফাকি দিয়ে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। আলী ইবনে আবী তালেব (রাঃ) কে স্বীয় বিছানায় ঘুমিয়ে থাকতে বলেন। তারপর তিনি তাকে তার বিছানায় ঘুমিয়ে রেখে, কৌশলে ঘর থেকে বের হয়ে যান। কাফেররা সারা রাত জানালা দিয়ে আলী (রাঃ) এর বিছানার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। তারা মনে করছিল রাসূল (ﷺ) এখানে শুয়ে আছে। এ ফাকে রাসূল (ﷺ) আবু বকর (রাঃ) কে সঙ্গে নিয়ে স্বীয় ঘর থেকে বের হয়ে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। যাদুল মায়াদ: ৫৪/৩, সীরাতে ইবনে হিশাম ৯৫/২, বিদায়া নিহায়া ১৭৫/৩, মাহমুদ শাকের রহ. এর তারিখে ইসলামী ১৪৮/২ এবং হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব পৃ: ১৫৬, রাহীকুল মাখতুম, পৃ: ১৩২।

রাসূল (ﷺ) যে কত বড় হিকমতের অধিকারী, ধৈর্যশীল ও সাহসী ছিলেন, তার জ্বলন্ত প্রমাণ হল, তার হিজরত করা। কারণ, তিনি যখন বুঝতে পারলেন, কুরাইশরা তার দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করছে এবং তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চাচ্ছে, তখন তিনি অপর একটি জায়গার সন্ধান করলেন, যেখানে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দেয়া যায়। মক্কার কাফেররা তার বিরোধিতা করাতে তিনি কোন প্রকার হতাশ হননি। তিনি মদিনার লোকদের থেকে প্রতিশ্রুতি নেন, যাতে তারা ইসলাম ও মুসলিমের সহযোগিতা করে এবং বহি: শত্রুর বিরোধিতা ও তাদের নির্যাতন থেকে তাদের হেফাজত করে।

তিনি দুটি মজলিশে তাদের সাথে এ চুক্তি সম্পন্ন করেন। ইসলামের ইতিহাসে এ দুটি চুক্তিকে আকাবায়ে উলা ও আকাবায়ে সানিয়া বলা হয়। রাসূল (ﷺ) যখন নিশ্চিতভাবে দাওয়াতের একটি ক্ষেত্র পেলেন এবং ইসলাম ও মুসলিমদের সহযোগিতা করার মত যোগ্য লোক পেলেন, তখন তিনি তার সাহাবীদের হিজরতের অনুমতি দেন। রাসূল (ﷺ) কুরাইশদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে উন্নত কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি তাদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ফলায়ন করেননি, তার মধ্যে কোন প্রকার দুর্বলতা দেখা যায়নি এবং মৃত্যু ভয়েও তিনি আতংকিত হননি বা পলায়ন করেননি, বরং উন্নত উপায়ই তিনি অবলম্বন করেন। তিনি যে পদ্ধতি অবলম্বন করেন এটিই হল দাওয়াতি কাজের সফলতার জন্য সর্বোত্তম পদ্ধতি ও হিকমত। যারা আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করে, তাদের রাসূল (ﷺ) এর এ ঘটনা ও জীবনী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেত হবে। কারণ, রাসূল (ﷺ) হল, দা‘ঈদের জন্য আদর্শ ও তাদের ইমাম। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে আ‘মাল করার তাওফীক দান করুন।


দ্বিতীয় অধ্যায়
হিজরতের পর রাসূল (ﷺ) এর কার্যক্রমের বিবরণ
প্রথম পরিচ্ছেদ
 উম্মতের সংশোধন করা ও তাদের মানুষরুপে গড়ে তোলার বিষয়ে রাসূল (ﷺ) হিকমত ও বুদ্ধি ভিত্তিক অবস্থান:
রাসূল (ﷺ) মদিনায় পৌঁছে দেখেন যে, মদিনার অধিবাসীরা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত এবং তারা নানাবিধ বিপরীতমুখী বিশ্বাসে জরজরিত। তারা তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী, তাদের চিন্তা চেতনায় একে অপরের সাথে কোন প্রকার মিল নেই। তাদের মধ্যে নতুন ও পুরাতন বিভিন্ন ধরনের মতানৈক্য ও মতপার্থক্যের কোন অভাব ছিল না। কিছু পার্থক্য ছিল এমন যেগুলো তারা নিজেরা আবিষ্কার করে, আর কিছু ছিল যে গুলো তারা তাদের পূর্বসূরিদের থেকে মিরাসি সূত্রে পায়। মদিনার এ দ্বিধা বিভক্ত লোকগুলোকে ইতিহাসের আলোকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।
এক. আওস, খাযরাজ ও মুহাজির মুসলিম।
দুই. আওস ও খাযরাজের মুশরিকরা; যারা ইসলামে প্রবেশ করেনি।
তিন. ইয়াহুদি সম্প্রদায়। তারাও আবার একাধিক গোত্রে বিভক্ত ছিল। যেমন, বনী কাইনুকা; যারা ছিল খাজরায গোত্রের সহযোগী। বনী নাজির ও বনী ক্বুরাইজা; এ দুটি গোত্র আওস গোত্রের লোকদের সহযোগী ছিল।
এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে, আওস ও খাযরাজ গোত্রের মধ্যে দ্বন্ধ ছিল প্রাচীন ও ঐতিহাসিক। জাহিলিয়্যাতের যুগে তারা উভয় গোত্র সব সময় যুদ্ধ বিদ্রোহে লিপ্ত থাকত। যুগ যুগ ধরে তারা সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে যুদ্ধ চালাতো। তারা এতই খারাপ ছিল, তাদের অন্তরে সব সময় যুদ্ধের দাবানল জ্বলতে থাকত এবং যুদ্ধ করা ছিল তাদের নেশা।আল বিদায়া নেহায়া: ২১৪/৩, সীরাতে ইবনে হিশাম: ১১৪/২, যাদুল মায়াদ ১৫৩/২, রাহীকুল মাখতুম ১৭১, হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব: ১৭৪ তারিখে ইসলামী মাহমুদ শাকের ৬২/৩, বুখারি ৪২৮, মুসলিম কিতাবুল মাসাজেদ, পরিচ্ছেদ: মসিজদ নির্মাণ প্রসঙ্গ হাদীস নং ৫২৪।

রাসূল (ﷺ) মদিনায় পৌঁছে প্রথমেই তিনি তার স্বীয় বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞান ও কৌশল দিয়ে এ সব সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সে গুলোকে সমাধানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এসব সমস্যা সমাধান, বাস্তব প্রেক্ষাপটকে নিয়ন্ত্রণ করা ও তাদের সবাইকে একটি ফ্লাট ফর্মে দাড় করানোর জন্য তিনি নিম্ন বর্ণিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেন।

 এক. মসজিদ নির্মাণ করার কাজে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
প্রথমে রাসূল (ﷺ) যে কাজটি আরম্ভ করেন, তা হল, মসজিদে নববীর নির্মাণ কাজ। তিনি সবাইকে এ কাজে অংশ গ্রহণ করার সুযোগ দেন, যার ফলে সমস্ত মুসলিমরা এ কাজে অংশ গ্রহণ করেন। তাদের নেতৃত্বে থাকেন তাদের ইমাম মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। এটি ছিল পরস্পর সহযোগিতামূলক ও সম্মিলিতভাবে সম্পাদিত ইসলামের সর্ব প্রথম কাজ। এ কাজের মাধ্যমে সবার মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব তৈরি হয় এবং মুসলিমদের কাজের জন্য সাধারণ লক্ষ্য নির্ধারণ হয়। রাসূল (ﷺ) মদিনায় আগমনের পূর্বে মদিনার প্রতিটি গোত্রের জন্য একটি নির্ধারিত স্থান ছিল, তাতে তারা একত্র হয়ে গান, বাজনা, কিচ্ছা, কাহিনী, কবিতা পাঠ ইত্যাদির অনুষ্ঠান করত। তাদের এক গোত্র অপর গোত্রের লোকদের নিকট গিয়ে বসত না এবং তাদের অনুষ্ঠানে যোগ দিত না। এতে স্পষ্ট হয় যে, তাদের মধ্যে মত পার্থক্য ও দ্বন্ধ কতই না তীব্র ছিল। কিন্তু রাসূল (ﷺ) যখন মসজিদ বানালেন, তা সমগ্র মুসলিমদের জন্য একটি মিলন কেন্দ্রে পরিণত হল। তারা সবাই সব ধরনের মত পার্থক্য ভুলে গিয়ে একই সময়ে এক সাথে মসজিদে একত্র হত। এ মসজিদেই তারা কোন কিছু জানার জন্য রাসূল (ﷺ) এর নিকট জিজ্ঞাসা করত; তাদের যাবতীয় সমস্যার সমাধান এখান থেকেই সমাধান করতে চেষ্টা করত। আর রাসূল (ﷺ) তাদের সবাইকে মসজিদে একত্র করে ইসলাম ও ঈমানের তালিম দিতেন, সঠিক পথ দেখাতেন এবং সময় উপযোগি দিক নির্দেশনা দিয়ে তাদের ধন্য করতেন। ()দেখুন: বুখারি ,কিতাবু মানাকিবিল আনছার পরিচ্ছেদ: রাসূল (ﷺ) ও তার সাহাবীদের হিজরত , হাদিস নং ৩৯০৬, ২৪০, ২৩৯/৭
রাসূল (ﷺ) এর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ধীরে ধীরে মদিনাবাসী একটি ফ্লাট ফর্মে আসতে আরম্ভ করে, তাদের মধ্যে মিল, মহব্বত ও ভালোবাসার সু-বাতাস বইতে শুরু করে এবং তারা ঐক্যের বন্ধনে একত্র হতে থাকে। বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা তাদের মধ্যে সুদীর্ঘ কালের জট বাধা ভেদাভেদ ও শত্রুতা ভুলতে থাকে, তৈরি হয় তাদের মধ্যে মিল-মহব্বত ও মৈত্রী। আর তারা অতীতকে ভুলে চলে আসে একে অপরের কাছাকাছি। তাদের শত্রুতা পরিণত হয় বন্ধুত্বে, তাদের অনৈক্য ও বিবাদ রূপ নেয় ঐক্য ও মমতায়। রাসূল (ﷺ) এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মদিনায় কোন প্রকার বিভক্তি ও দলাদলি আর অবশিষ্ট থাকল না। জাহিলিয়্যাতের সব অন্ধকার আলোর সন্ধান পেতে আরম্ভ করল। বরং তারা সবাই অতীতকে পিছনে রেখে এখন ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হল। তারা আর কোন উপদলে বিভক্ত না থেকে একজনের নেতৃত্বে একত্রিত হল। আর তিনি হলেন, মানবতার অগ্রদূত রাসূল (ﷺ), যিনি তার প্রভুর পক্ষ হতে আদেশ নিষেধ গ্রহণ করে উম্মতদের শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব লাভ করেন। রাসূল (ﷺ) এর তা‘লীম-তরবিয়ত ও শিক্ষা-দীক্ষা দ্বারা মুসলিমগণ এখন একই কাতারে অবস্থান করছে; তাদের মধ্যে এখন আর কোন দলাদলি ও রেশারেশি নেই। রাসূল (ﷺ) এর তালীমের বদৌলতে তাদের অন্তরে একে অপরের প্রতি সহানুভূতি ও সহযোগিতার মানসিকতা তৈরি হয়। তাদের মধ্যে কোন প্রকার হিংসা-বিদ্বেষে ও পরশ্রিকাতরতা অবশিষ্ট রইল না, তাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় হল, ঐক্য মজবুত হল এবং তারা একে অপরের সহযোগী ও হিতাকাংক্ষি হিসেবে পরিণত হল। ()দেখুন: মাহমুদ শাকেরের তারিখুল ইসলাম ১৬২/২, রাহীকুল মাখতুম, ১৭৯।

মসজিদ শুধু মাত্র পাঁচ ওয়াক্ত স্বলাত আদায়ের স্থান ছিল না, বরং মসজিদ হল, মুসলিম উম্মাহর যাবতীয় সমস্যা সমাধানের মূল কেন্দ্র। শিক্ষা, দীক্ষাসহ সবকিছুই এখান থেকেই পরিচালিত হত। সবাই এখানে এসে একত্র হত, যাতে তাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের পুরনো যত ধরনের বিভেদ ছিল, তা আর না থাকে, এখানে এসে তারা তাদের অতীতের সব কিছু ভুলে যায় এবং দীর্ঘকাল থেকে লালিত জাহিলি যুগে তাদের সব ধরনের বিরোধ এখানে আসলে ধূলিসা হয়ে যায়। মসজিদই হল, সমস্ত কার্যক্রম চালানোর প্রশাসনিক ভবন এবং সব ধরনের ফরমান জারির একমাত্র প্রাণ কেন্দ্র। এখানেই সব ধরনের বুদ্ধি পরামর্শ করা হত, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হত এবং এখান থেকেই তা প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা হত।

এ কারণে রাসূল (ﷺ) যেখানেই অবস্থান করতেন, তার প্রথম কাজ ছিল মসজিদ নির্মাণ করা; যাতে মুমিনরা এক জায়গায় একত্র হতে পারে। হিজরতের প্রাক্কালে রাসূল (ﷺ) যেখানে প্রথম অবস্থান করেন, সেখানেও একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, যে মসজিদটি বর্তমানে মসজিদে কুবা নামে পরিচিত। তারপর কুবা ও মদিনার মাঝামাঝি বনী সালেম ইবনে আওফে তিনি অবস্থান করেন। সেখানে তিনি জুমার স্বলাত আদায় করে মসজিদের সূচনা করেন। মদিনায় পৌঁছে রাসূল (ﷺ) কোন প্রকার কালক্ষেপন না করে অতি তাড়াতাড়ি সর্ব প্রথম মসজিদ নির্মাণের কাজে হাত দেন।)০দেখুন: সীরাতে নববীয়াহ শিক্ষা ও উপদেশ পৃ: ৭৪, ফিকহুসসীরাহ ১৮৯, হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব: ১৮০।

 দুই. ইয়াহুদীদের জ্ঞানগর্ভ কথা ও হিকমতের মাধ্যমে ইসলামের দিকে দা‘ওয়াত:
রাসূল (ﷺ) মদিনায় প্রবেশের পর একটি উন্নত জাতি গঠন ও তাদের সংশোধনের লক্ষে আব্দুল্লাহ ইবনে সালামের মাধ্যমে ইয়াহুদীদের সাথে যোগাযোগ কায়েম করেন এবং তাদের ইসলামের দিকে দা‘ওয়াত দিতে আরম্ভ করেন। এ কারণে ইসলামের ইতিহাসে আব্দুল্লাহ ইবন সালামের ইসলাম গ্রহণ ইসলামের অগ্রযাত্রা ও মুসলিমদের উন্নতির একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক। তার ইসলামের মাধ্যমে ইয়াহুদীদের মধ্যে ইসলামের প্রতি দূর্বলতা তৈরি হয় এবং মদীনার অন্যান্য লোকদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি হয়। কারণ, আব্দুল্লাহ ইবন সালাম ছিল ইয়াহুদীদের মধ্যে বড় আলেম। আগেকার আসমানী কিতাবসমুহে আখেরী নবী সম্পর্কে যে সব ভবিষ্য বাণী ছিল তা সবই তার জানা ছিল। তাই তার মত এমন একজন লোকের ইসলাম গ্রহণ নি:সন্দেহে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। আব্দুল্লাহ ইবন সালামের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা নিম্নরূপ।

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«فعن أنس قال: بلغ عبد اللَّه بن سلام مقدم النبي صلى الله عليه وسلم إلى المدينة، فأتاه، فقال: إني سائلك عن ثلاث لا يعلمهن إلا نبي، قال: ما أول أشراط الساعة؟ وما أول طعام يأكله أهل الجنة، وما بال الولد ينزع إلى أبيه أو إلى أمه؟ فقال رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم: [خبرني بهن آنفاً جبريل[ قال ابن سلام: ذاك عدو اليهود من الملائكة، فقال رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم: [أما أول أشراط الساعة فنار تحشر الناس من المشرق إلى المغرب، وأما أول طعام يأكله أهل الجنة فزيادة كبد حوت، وأما الشبه في الولد فإن الرجل إذا غشي المرأة فسبقها ماؤه كان الشبه له، وإذا سبق ماؤها كان الشبه لها[قال: أشهد أن لا إله إلا اللَّه، وأنك رسول اللَّه]، قال: يا رسول اللَّه، إن اليهود قوم بُهْتٌ، إن علموا بإسلامي قبل أن تسألهم بَهَتُوني عندك، [فأرسل نبي اللَّه صلى الله عليه وسلم فأقبلوا فدخلوا عليه، فقال لهم رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم: [يا معشر اليهود، ويلكم اتقوا اللَّه فواللَّه الذي لا إله إلا هو إنكم لتعلمون أني رسول اللَّه حقاً، وأني جئتكم بحق، فأسلموا[، قالوا: ما نعلمه، قالوا للنبي صلى الله عليه وسلم -قالها ثلاث مرات – فقال رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم: [فأي رجل فيكم عبد اللَّه بن سلام؟[ قالوا: سيدنا وابن سيدنا، وأعلمنا وابن أعلمنا، قال: [أفرأيتم إن أسلم؟[ قالوا: حاشا للَّه ما كان ليسلم، قال: [أفرأيتم إن أسلم؟[ قالوا: حاشا للَّه ما كان ليسلم، قال: [أفرأيتم إن أسلم؟[ قالوا: حاشا للَّه ما كان ليسلم، قال: [يا ابن سلام اخرج عليهم[، فخرج فقال: يا معشر اليهود، اتقوا اللَّه فواللَّه الذي لا إله إلا هو إنكم لتعلمون أنه رسول اللَّه، وأنه جاء بحق، فقالوا: كذبت، [شرنا، وابن شرنا]، ووقعوا فيه»

রাসূল (ﷺ) এর মদিনায় আগমনের খবর আব্দুল্লাহ ইবনে সালামের নিকট পৌছলে তিনি রাসূল (ﷺ) এর দরবারে এসে বলে আমি তোমাকে তিনটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করব যে তিনটি বিষয়ের উত্তর একমাত্র নবী ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না। এক- কিয়ামতের প্রথম আলামত কি? দুই-জান্নাতীদের প্রথম খাবার কি হবে যা তারা জান্নাতে খাবে? তিন- সন্তান কখনো মায়ের মত আবার কখনো পিতার মত হয় এর কারণ কি? রাসূল (ﷺ) তাকে বললেন, জিবরিল (আঃ) একটু আগে আমাকে তোমারা প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে জানালেন, এ কথা শোনে আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম বলল, জিবরিল হল, ফেরেশতাদের মধ্য হতে ইহুদীদের বড় শত্রু। রাসূল (ﷺ) বললেন, তোমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর হল, প্রথম কিয়ামতের আলামত আগুন যা পশ্চিম থেকে পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত সমগ্র মানুষকে এক জায়গায় একত্র করবে। আর জান্নাতিদের প্রথম খাবার হবে মাছের কলিজা। আর বাচ্চাদের মাতা পিতার সাদৃশ্য হওয়ার বিষয়টি নারী পরুষের মিলনের সময় যদি পুরুষের বীর্য নারীদের বীর্যের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে, তখন বাচ্চা পুরুষের মত হয়, অন্যথায় নারীদের মত হয়। রাসূল সা,. উত্তর শোনার পর আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম বলল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই, অবশ্যই আপনি আল্লাহর রাসূল। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল ইহুদীরা হল, অকৃতজ্ঞ জাতি। আপনি তাদের আমার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করার পূর্বে তারা যদি আমার ইসলাম বিষয়ে জানে, তবে তারা আমাকে হেয় করবে। তারপর রাসূল (ﷺ) তাদের সংবাদ দিয়ে একত্র করলেন এবং তাদের বললেন, হে ইহুদী সম্প্রদায়! সাবধান তোমরা আল্লাহকে ভয় কর! আমি ঐ আল্লাহর শপথ করে বলছি, যিনি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নাই, তোমরা অবশ্যই জান আমি আল্লাহর পক্ষ হতে প্রেরিত রাসূল। আমি তোমাদের নিকট সত্যের পয়গাম নিয়ে এসেছি। তোমরা আমার আনুগত্য কর এবং ইসলাম গ্রহণ কর। তারা সবাই বলল, আমরা এ বিষয়ে কিছুই জানি না। রাসূল (ﷺ) তাদের তিনবার জিজ্ঞাসা করেন এবং তারাও তিনবার একই উত্তর দেন। তারপর রাসূল তাদের জিজ্ঞাসা করেন, আবদুল্লাহ ইবনে সালাম তোমাদের মধ্যে কেমন লোক? তারা সবাই এক বাক্যে বলল, তিনি আমাদের সরদার এবং সরদারের ছেলে সরদার। আর তিনি আমাদের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী লোক এবং সর্বাধিক জ্ঞানী লোকের ছেলে। তারপর রাসূল (ﷺ) বললেন, সে যদি ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে তোমরা তাকে কীভাবে দেখবে? তারা বলল, আল্লাহ তাকে হেফাযত করুক! সে কখনই ইসলাম গ্রহণ করার নয়! তিনি বললেন, হে আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম তুমি ইহুদীদের নিকট বের হয়ে আস! তারপর তিনি বের হয়ে বললেন, হে ইহুদী সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর! যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্যিকার ইলাহ নাই, আমি তার শপথ করে বলছি, তোমরা ভালো করেই জান অবশ্যই তিনি আল্লাহর রাসূল। তিনি আমাদের নিকট সত্যের পয়গাম নিয়ে আসছেন। তার কথা শোনে তারা সবাই বলল, তুমি মিথ্যা বলছ, তুমি আমাদের মধ্যে সর্বাধিক নিকৃষ্ট ব্যক্তি এবং সর্বাধিক নিকৃষ্ট ব্যক্তির ছেলে। তারা তার সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের অপবাদ দেয়া আরম্ভ করে।() বুখারি, কিতাব নবীদের বর্ণনা হাদীস নং ৩৯১১, এবং মানাকিবুল আনসার হাদীস- ৩৯১১, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২১০/৩

মদীনায় প্রবেশের পর এ ঘটনা ছিল ইহুদীদের সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) এর প্রথম অভিজ্ঞতা। ()()আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ; ২১৪/৩, সীরাতে ইবনে হিশাম: ১১৪/২, যাদুল মায়াদ ১৫৩/২, রাহীকুল মাখতুম ১৭৫, হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব: ১৭৫, মাহমুদ শাকেরের তারিখে ইসলামী ১৭৩/২। ইমাম গাজালির ফিকহুস-সীরাহ পৃ: ১৯৮।

রাসূল (ﷺ) এর বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল হল, তিনি প্রথমে আব্দুল্লাহ ইবনে সালামকে লুকিয়ে থাকতে বলেন, যাতে তার সম্পর্কে সংবাদ দেয়ার পূর্বেই তাদের থেকে তার মান মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে স্বীকারোক্তি আদায় করেন। তারপর যখন তারা প্রশংসা করল, তার মান-মর্যাদা তুলে ধরল, তখন রাসূল (ﷺ) তাকে বের হয়ে আসতে বললেন, রাসূল (ﷺ) এর নির্দেশে সে ভিতর থেকে বের হয়ে রাসূল (ﷺ) রিস্বলাতের সাক্ষ্য দিল এবং ইহুদীরা রাসূল (ﷺ)-এর আগমনের সত্যতা সম্পর্কে যা গোপন করত, তা প্রকাশ করে দেন।

 তিন. মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব
মদিনায় হিজরতের পর রাসূল (ﷺ) যেভাবে মসজিদ নির্মাণ ও ইয়াহুদীদের ইসলামের দিকে ডাকতে আরম্ভ করেন, অনুরূপভাবে আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে সুসম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছিল সঠিক সমাধান, নবুওয়তের পরিপূর্ণতা, সুক্ষ্ম কৌশল এবং মুহাম্মদী হিকমত। () দেখুন: আবু বকর আল জাযায়েরির হাযাল হাবীব ইয়া মুহিব্ব পৃ: ১৭৮ ।

মদিনায় রাসূল (ﷺ) আনাস ইবনে মালিকের গৃহে আনসার ও মুহাজিরদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব কায়েম করেন। নব্বই জন সাহাবী তার ঘরে একত্রিত হয়; অর্ধেক আনসার আর বাকী অর্ধেক মুহাজির। তাদের সম্পর্ক বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এতই নিবিড় ছিল, একজন মারা গেল তার সম্পত্তিতে অপরজন অংশ পেত। অথচ তার সাথে রক্তের কোন সম্পর্ক ছিল না। তারপর যখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন, তখন উত্তরাধিকার শুধু মাত্র রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
﴿وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مِنۢ بَعۡدُ وَهَاجَرُواْ وَجَٰهَدُواْ مَعَكُمۡ فَأُوْلَٰٓئِكَ مِنكُمۡۚ وَأُوْلُواْ ٱلۡأَرۡحَامِ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلَىٰ بِبَعۡض فِي كِتَٰبِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمُۢ ﴾ [الأنفال:75 ]
অর্থ, আর যারা পরে ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবঙ তোমাদের সাথে জিহাদ করেছে, তারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত, আর আত্মীয়-স্বজনরা একে অপরের তুলনায় অগ্রগণ্য, আল্লাহর কিতাবে। নিশ্চয় আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ে মহাজ্ঞানী।সুরা আনফাল: আয়াত: ৭৫।

রাসূল (ﷺ) তাদের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেন, তা শুধু কাগজের লেখা বা মুখের কথা ছিল না। বরং তাদের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেছিল তা ছিল তাদের অন্তরের গাথা একটি চিরন্তণ বন্ধন, তা ছিল তাদের জান মালের সাথে একাকার ও অভিন্ন। তাদের কথা ও কাজে ছিল একটি চিরন্তন ও স্থায়ী সম্পর্কের বহি:প্রকাশ। বিপদে আপদে তারা ছিলেন একে অপরের হিতাকাংক্ষি ও সহযোগী। বুখারিতে এ বিষয়ে একটি উ কৃষ্ট দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হয়-
«آخى رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم بين عبد الرحمن بن عوف، وسعد بن الربيع، فقال سعد: قد علمت الأنصار أني من أكثرها مالاً، فأقسم مالي بيني وبينك نصفين، ولي امرأتان، فانظر أعجبهما إليك فسمها لي أطلقها، فإذا انقضت عدتها فتزوجها، فقال عبد الرحمن: بارك اللَّه لك في أهلك ومالك، أين سوقكم؟ فدلوه على سوق بني قينقاع فما انقلب إلا ومعه فضل من أقط وسمن، ثم تابع الغدوة ثم جاء يوماً وبه أثر صُفرة، فقال النبي صلى الله عليه وسلم: [مَهْيَم؟[، قال: تزوجت امرأة من الأنصار، فقال: [ما سقت فيها؟[ قال: وزن نواة من ذهب، أو نواة من ذهب، فقال: [أولِم ولو بشاة»
অর্থ, আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) ও সায়াদ ইবনে রবি (রাঃ) উভয়ের মাঝে রাসূল (ﷺ) সুসম্পর্ক কায়েম ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেন। তখন সায়াদ (রাঃ) তার সাথীকে বলল, আনসারীরা জানে আমি সম্পদের দিক দিয়ে তাদের চেয়ে অধিক সম্পদের অধিকারি। সুতরাং, তুমি আমার যাবতীয় সম্পদকে তোমার মধ্যে ও আমার মধ্যে দুই ভাগ করে নাও; অর্ধেক তোমার আর বাকী অর্ধেক আমার। আর আমার দুটি স্ত্রী আছে তাদের মধ্যে তোমার নিকট যাকে পছন্দ হয়, তার নাম নিয়ে বল, আমি তাকে তালাক দিয়ে দিব তারপর যখন তার ইদ্দত শেষ হয়ে যাবে, তখন তুমি তাকে বিবাহ করবে। এ সব কথা শোনে আব্দুর রহমান তার সাথীকে বলল, আল্লাহ তা‘আলা তোমার পরিবার ও জান- মালের মধ্যে বরকত দান করুন। তোমাদের বাজার কোথায়? তারা বনী কায়নুকা নামক বাজারের সন্ধান দিলে, সেখান থেকে সে সামান্য পণীর ও ঘি নিয়ে ফিরে আসে। তারপর তারা দুপুরের খাওয়া খায়। এরপর সে একদিন রাসূল (ﷺ) এর নিকট আসে তার দেহে লাল রং এর আলামত পরিলক্ষিত দেখে রাসূল (ﷺ) তাকে বলল, তোমার কি অবস্থা? উত্তরে সে বলল, আমি একজন আনসারী নারীকে বিবাহ করেছি। তখন রাসূল তাকে বলল, এ বিষয়ে তুমি কি খরচ করেছ? সে বলল, একটি খেজুরের আটি পরিমাণ স্বর্ণ। তারপর রাসূল (ﷺ) তাকে বললেন, তুমি ওলিমা খাওয়াও! যদি না পার তাহলে কমপক্ষে একটি ছাগল হলেও খাওয়াও।।() বুখারি, কিতাবু মানাকিবিল আনসার পরিচ্ছেদ: মুহাজির ও আনসারিদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন বিষয়, হাদীস নং ৩৭৮০, ৩৭৮১।

 চার. হিকমতপূর্ণ তালীম:
রাসূল (ﷺ) মদিনায় মুসলিমদের তা‘লীম, তরবিয়াত, আত্মার পরিশুদ্ধি ও উত্তম আখলাক শেখানোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি অত্যন্ত মহব্বত ও ভালোবাসার সাথে তাদের ইসলামী শিষ্টাচার ও ইবাদত বন্দেগীর তা‘লীম দিতেন। আর রাহীকুল মাখতুম ১৭৯, ২০৮,১৮১ মাহমুদ শাকের এর তারিখে ইসলামী ১৬৫/২।
রাসূল (ﷺ) বলতেন,
«يا أيها الناس: أفشوا السلام، وأطعموا الطعام، وصلوا بالليل والناس نيام، تدخلوا الجنة بسلام»
অর্থ, হে মানুষ! তোমরা সালামের প্রসার কর, মেহমানের মেহমানদারী কর, মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন তোমরা স্বলাত আদায় কর, আর নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ কর। ()তিরমিযি, কিতাব কিয়ামতের বর্ণনা ২৪৮৫ ইমাম তিরমিযি হাদীসটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন। আর ইবনে মাযা কিতাবুল আতয়েমাহ পরিচ্ছেদ: হাদীস নং ১০৮৩/২, ৩২৫১, দারামী ১৫৬/১ এবং আহমদ ১৬৫/১।

তিনি আরও বলেন,
«لا يدخل الجنة من لا يأمن جاره بوائقه»
অর্থ, যার অত্যাচার থেকে প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজন নিরাপদ থাকতে পারে না, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। ()মুসলিম কিতাবুল ঈমান পরিচ্ছেদ: প্রতিবেশীদের কষ্ট দেয়া বিষয়ে, হাদীস নং ৪৬
« المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده. »
অর্থ, সত্যিকার মুসলিম সে ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলিমরা নিরাপদে থাকে।()বুখারি কিতাবুল ঈমান পরিচ্ছেদ: কোন ইসলাম উত্তম? ৫৪/১ মুসলিম কিতাবুল ঈমান পরিচ্ছেদ: بيان تفاضل الإسلام وأي الأمور أفضل হাদীস নং ৪১।

রাসূল (ﷺ) আরও বলেন,
«لا يؤمن أحدكم حتى يحب لأخيه ما يحب لنفسه»
অর্থ, যে ব্যক্তি নিজের জন্য যা পছন্দ করে, তা তার অপর ভাইয়ের জন্য পছন্দ না করা পর্যন্ত সে প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না। ()বুখারি কিতাবুল ঈমান পরিচ্ছেদ: নিজের জন্য যা ভালো বাসে অপরের জন্য তা ভালো বাসা বিষয়ে হাদীস নং ১৩, ৫৬/১, মুসলিম কিতাবুল ঈমান: باب الدليل على أن من خصال الإيمان أن يحب لأخيه ما يحب لنفسه، ৬৭/১।

রাসূল (ﷺ) বলেন,
«المؤمن للمؤمن كالبنيان يشد بعضه بعضا، وشبك بين أصابعه»
অর্থ, একজন মুমিন অপর মুমিনের জন্য প্রাচীরের ন্যায়, তার একটি অংশ অপর অংশকে শক্তি যোগায়। রাসূল (ﷺ) এ কথা বলে আঙ্গুল গুলোকে জড়ো করে দেখান।বুখারি, কিতাবুস স্বলাত পরিচ্ছেদ মসজিদে আঙ্গুল ফুটানো বিষয়ে ৪৮১ মুসলিম কিতাবুল বির ওয়াস সিলাহ পরিচ্ছেদ: মুমিনদের পরস্পর ভালোবাসা, সহযোগিতা করা ও দয়া করা ২৫৮৫। ()

রাসূল (ﷺ) আরও বলেন,
«لا تحاسدوا، ولا تناجشوا، ولا تباغضوا، ولا تدابروا، ولا يبع بعضكم على بيع بعض، وكونوا عباد اللَّه إخواناً، المسلم أخو المسلم، لا يظلمه، ولا يخذله، ولا يحقره، التقوى هاهنا[ – ويشير إلى صدره ثلاث مرات – [بحسب امرئ من الشر أن يحقر أخاه المسلم، كل المسلم على المسلم حرام: دمه، وماله وعرضه»
অর্থ, তোমরা পরস্পর বিদ্বেষ করো না ধোঁকা দেবে না, হিংসা করবে না এবং দুর্নাম করবে না। আর কারো বেচা-কেনার উপর হস্তক্ষেপ করবে না। আর তোমরা আল্লাহর বান্দা ও ভাইয়ে পরিণত হও। একজন মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে কাউকে অপমান করে না। কাউকে ঠকায় না এবং কারো উপর অত্যাচার করে না। আর তাকওয়া এখানে। এ বলে রাসূল (ﷺ) স্বীয় বক্ষের দিকে তিনবার ইশারা করে। একজন মানুষ নিকৃষ্ট হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার একজন ভাইকে অপমান করা। প্রতিটি মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের রক্তপাত, ধন-সম্পদ আত্মসা ও ইজ্জত সম্মানহানী করা হারাম করা হয়েছে।।() ()মুসলিম, কিতাবুল বির ওয়াস সিলাহ পরিচ্ছেদ: কোন মুসলিমের উপর জুলুম করা, তাকে অপমান করা, তাকে ছোট করে দেখা এবং কোন মুসলিমের জান মাল ও ইজ্জত সম্মান হনন করা হারাম হওয়া বিষয়ে; হাদীস ২৫৬৪।

«وقال لا يحل لمسلم أن يهجر أخاه فوق ثلاث ليال، يلتقيان فيعرض هذا، ويعرض هذا، وخيرهما الذي يبدأ بالسلام»
অর্থ, রাসূল (ﷺ) আরও বলেন, একজন মুসলিম তার অপর ভাইকে তিন রাতের বেশি ছেড়ে রাখতে পারে না। তারা একে অপরের সাথে মিলিত হলে একজন এদিক আরেকজন অন্যদিক ফিরে থাকে। তাদের উভয়ের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে আগে সালাম দেয়।।()বুখারি, কিতাবুল আদব পরিচ্ছেদ ছেড়ে দেয়া ও রাসূল (ﷺ) এর বাণী لا يحل لرجل أن يهجر أخاه فوق ثلاث بلا عذر شرعي، অর্থাৎ শরয়ী কোন ওজর ব্যতিত কোন লোকের সাথে তিন দিনের বেশি সম্পর্ক না রাখা হারাম হওয়া প্রসঙ্গে ২৫৬০।

রাসূল (ﷺ) আরও বলেন,
« وقال: تفتح أبواب الجنة يوم الإثنين، ويوم الخميس، فيغفر لكل عبد لا يشرك باللَّه شيئاً إلا رجلاً كانت بينه وبين أخيه شحناء، فيقال: انظِروا هذين حتى يصطلحا، انظِروا هذين حتى يصطلحا، انظِروا هذين حتى يصطلحا»
অর্থ, সোমবার ও বৃহ:বারে জান্নাতের দরজাসমূহ খোলা হয়ে থাকে। তখন আল্লাহ তা‘আলা যেসব বান্দাগণ আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরিক করে না তাদের ক্ষমা করে দেন। তবে কোন ব্যক্তি যদি এমন হয়, তার মধ্যে ও তার ভাইয়ের মধ্যে দুশমনি থাকে তবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করেন না। আল্লাহ তার ফেরেশতাদের বলেন, তোমরা এ দুজনকে সুযোগ দাও, যাতে তারা আপোষ করে ফেলে। তোমরা এ দুজনকে সুযোগ দাও যাতে তারা আপোষ করে ফেলে। তোমরা এ দুজনকে সুযোগ দাও যাতে তারা আপোষ করে ফেলে। ()বুখারি ৫৬/১ মুসলিম ২৫৬৫, ১৯৮৭/৪।

«وقال: ]تعرض الأعمال في كل يوم خميس وإثنين فيغفر اللَّه في ذلك اليوم لكل امرئٍ لا يُشرك باللَّه شيئاً إلا امرأ كانت بينه وبين أخيه شحناء، فيقال: اركوا هذين حتى يصطلحا، اركوا هذين حتى يصطلحا»
অর্থ, রাসূল (ﷺ) আরও বলেন আল্লাহ তা‘আলার নিকট সোমবার ও বৃহস্পতিবারে বান্দার আমলসমূহ পেশ করা হয়ে থাকে, তখন আল্লাহ তা‘আলা যারা আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করে তাদের ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। তবে কোন ব্যক্তি যদি এমন হয়, তার মধ্যে ও তার ভাইয়ের মধ্যে দুশমনি থাকে, তবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করেন না। তার বিষয়ে বলা হয়, তাকে তোমরা সুযোগ দাও! যাতে তারা আপোষ করে নেয়।) মুসলিম, কিতাবুল বির ওয়াস সিলাহ পরিচ্ছেদ: হিংস বিদ্বেষ ও সম্পর্কচ্ছেদ করা নিষেধ হওয়া প্রসংঙ্গে ক১৯৮৭/৪, ৩৬/২৫৬৫।

« وقال صلى الله عليه وسلم: [انصر أخاك ظالماً أو مظلوماً[ قيل: يا رسول اللَّه، هذا نصرته مظلوماً، فكيف أنصره إذا كان ظالماً؟ قال: [تحجزه أو تمنعه من الظلم فذلك نصره»
অর্থ, রাসূল (ﷺ) বলেন, তোমরা তোমার জালেম অথবা মাজলুম ভাই উভয়কে সহযোগিতা কর। একজন জিজ্ঞাসা করে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল মজলুমের সাহায্য করা আমরা বুঝতে পারলাম, কিন্তু যদি জালেম হয়, তাকে কিভাবে সাহায্য করব? রাসূল (ﷺ) বললেন, তাকে তোমরা বিরত রাখবে অথবা তাকে জুলুম করতে বাধা দিবে। ()বুখারি, কিতাবুল মাজালেম পরিচ্ছেদ: তোমার ভাই জালেম ও মাজলুকে সাহায্য কর। হাদীস নং ২৪৪৪, ২৪৪১, কিতাবুল ইকরাহ হাদীস ৬৯৫২, মুসলিম তোমার ভাই জালেম ও মজলুম কে সাহায্য কর হাদীস নং ২৫৮৫

«وقال: [حق المسلم على المسلم ست[، قيل: ما هن يا رسول اللَّه؟ قال: [إذا لقيته فسلِّم عليه، وإذا دعاك فأجبه، وإذا استنصحك فانصح له، وإذا عطس فحمد اللَّه فشمِّته، وإذا مرض فعُده، وإذا مات فاتبعه » [
রাসূল (ﷺ) বলেন, একজন মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমের উপর ছয়টি দায়িত্ব রয়েছে। জিজ্ঞাসা করা হল, সে গুলো কি হে আল্লাহর রাসূল!? রাসূল (ﷺ) উত্তর দেন, যখন তুমি তার সাথে সাক্ষাত করবে তাকে সালাম দেবে। যখন তোমাকে দা‘ওয়াত দিবে, তখন তুমি তার দা‘ওয়াতে সাড়া দেবে। যখন তোমার নিকট কোন উপদেশ চাইবে তখন তুমি তাকে উপদেশ দেবে। আর হাচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বললে, তুমি তার উত্তর দিবে। আর যখন অসুস্থ হবে, তুমি তাকে দেখতে যাবে। আর যখন মারা যাবে, তার জানাজায় শরিক হবে। ()বুখারি, কিতাবুল জানায়েয, পরিচ্ছে: জানাযায় অংশগ্রহণ করার নির্দেশ প্রসঙ্গে হাদীস নং ১২৪০ মুসলিম, কিতাবুস সালাম পরিচ্ছেদ এক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের হক হল, সালামের উত্তর দেয়া বিষয় হাদীস নয ১৭০৫/৪

« وعن البراء بن عازب قال: أمرنا رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم بسبع ونهانا عن سبع: [أمرنا بعيادة المريض، واتباع الجنازة، وتشميت العاطس، وإجابة الداعي, وإفشاء السلام، ونصر المظلوم، وإبرار المقسم، ونهانا عن خواتيم الذهب، وعن الشرب في الفضة[ – أو قال: [في آنية الفضة – وعن المياثر، والقسي)، وعن لبس الحرير، والديباج، والإستبرق».
বারা ইবনে আযেব (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (ﷺ) বলেন, রাসূল (ﷺ) আমাদের সাতটি আদেশ দেন এবং সাতটি বিষয়ে নিষেধ করেন। রাসূল (ﷺ) আমাদের রুগীদের দেখতে যাওয়া, জানাজায় শরিক হওয়া, হাঁচির উত্তর দেওয়া, সালামের প্রসার করা, মজলুমের সাহায্য করা, দা‘ওয়াতে সাড়া দেওয়া এবং শপথকারীকে দায়মুক্ত করার নির্দেশ দেন। আর তিনি আমাদের স্বর্ণের আংটি পরা, রুপার পাত্রে পান করা, রেশমের পোশাক পরিধান করা, রেশমের নির্মিত বিছানা, রেশমের দ্বারা খচিত কাপড়, দিবাজ ও ইসতাবরাক পরিধান করা হতে নিষেধ করেন। ()বুখারি কিতাবুল জানায়েয, পরিচ্ছে: জানাযায় অংশগ্রহণ করার নির্দেশ প্রসঙ্গে হাদীস নং ১২৩৯, ১১২/৩,৯৯/৫।

« وقال: [لا تدخلون الجنة حتى تؤمنوا، ولا تؤمنوا حتى تحابوا، أَوَلا أدلكم على شيء إذا فعلتموه تحاببتم، أفشوا السلام بينكم [».
রাসূল (ﷺ) বলেন, তোমারা পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়া ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর তোমরা পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না, তোমরা একে অপরকে মহব্বত করবে। আমি কি তোমাদের এমন একটি বিষয়ের সন্ধান দেব, যা পালন করলে তোমরা একে অপরকে মুহব্বাত করবে? তোমরা তোমাদের নিজেদের মধ্যে সালামের ব্যাপকতা বৃদ্ধি কর! ()মুসলিম, কিতাবুল ঈমান পরিচ্ছেদ: জান্নাতে শুধু মুমিনরাই প্রবেশ করবে বিষয়ে ৭৪/১ হাদীস নং ৫৪

« وسئل صلى الله عليه وسلم: أي الإسلام خير؟ فقال: [تطعم الطعام، وتقرأ السلام على من عرفت ومن لم تعرف »
রাসূল (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা করা হল, ইসলামে সর্বোত্তম আ‘মাল কোনটি? তখন রাসূল উত্তর দেন, মেহমানের মেহমানদারী করা, তুমি যাকে চিন বা যাকে চিন না সবাইকে সালাম দেয়া। ()বুখারি, কিতাবুল ঈমান পরিচ্ছেদ খানা খাওয়ানো ইসলাম হওয়া বিষয়ে ৫৫/১,১২ মুসলিম কিতাবুল ঈমান ৩৯

« ويقول: [مَثَل المؤمنين في توادهم وتراحمهم وتعاطفهم، كمثل الجسد إذا اشتكى منه عضو تداعى له سائر الجسد بالسهر والحمى. »
রাসূল (ﷺ) বলেন, মুমিনদের দৃষ্টান্ত পরস্পরের প্রতি দয়া, নম্রতা ও আন্তরিকতার দিক দিয়ে একটি দেহের মত। তাদের দেহের একটি অংশ আক্রান্ত হলে, তার সমগ্র অঙ্গ ব্যথা, যন্ত্রণা ও অনিদ্রায় আক্রান্ত হয়। ()বুখারি: কিতাবুল আদব পরিচ্ছেদ: মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তুর উপর দয়া করা বিষয়ে ৪৩৮/১০, ৬০১১ ৫৫/১, ১২ মুসলিম কিতাবুল বির ওয়াসসিলাহ পরিচ্ছেদ মুমিনদের প্রতি দয়া ও নমনীয়তা বিষয়ে ২০০০/৪, ২৫৮৬

« وقال صلى الله عليه وسلم: [من لا يرحَم لا يُرحم. »
রাসূল (ﷺ) আরও বলেন, যে ব্যক্তি রহম করে না তাকে রহম করা হবে না। ()বুখারি, কিতাবুল আদব পরিচ্ছেদ: মানুষের প্রতি দয়া ও নমনীয়তা বিষয়ে ৪৩৮/১০, ৬০১৩ মুসলিম, কিতাবুল ফাযায়েল باب رحمته الصبيان والعيال وتواضعه وفضل ذلك، হাদীস নং ২৩১৯।

« وقال: [من لا يرحم الناس لا يرحمه اللَّه تعالى. »
আরও বলেন, যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করে না আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতি দয়া করবে না। () মুসলিম ১৮০৯/৪, ২৩১৯।

« وقال صلى الله عليه وسلم: [سُباب المسلم فسوقٌ، وقتاله كفر. »
রাসূল (ﷺ) আরও বলেন, মুসলিমদের গালি দেয়া ফাসেকী আর কোন মুসলিমকে হত্যা করা হল, কুফরী। ()বুখারি, কিতাবুল ঈমান পরিচ্ছেদ: خوف المؤمن من أن يحبط عمله وهو لا يشعر হাদীস ৪৮ মুসলিম কিতাবুল ঈমান পরিচ্ছেদ রাসূল সা এর বাণী ((سباب المسلم فسوق وقتاله كفر)) হাদীস ৬৪।

রাসূল (ﷺ) এর উল্লেখিত বাণীসমূহ আনসারীদের নিকট রাসূল (ﷺ) হতে সরাসরি পৌঁছুক বা তারা মুহাজিরদের মাধ্যমে পৌঁছুক যারা হিজরতের পূর্বে রাসূল (ﷺ) থেকে শুনেছে, সবই হল, তাদের জন্য রাসূল (ﷺ) এর পক্ষ হতে বিশেষ তালিম ও শিক্ষা। এ ছাড়া কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত উম্মতের জন্য রাসূল (ﷺ) চিরন্তন বাণীসমূহ বিশেষ তালীম যা তারা তাদের জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারে।

এ ছাড়াও আরও অনেক হাদিস ও রাসূল (ﷺ) এর বাণী রয়েছে, যার মাধ্যমে তিনি তার সাহাবীদের তালীম দিতেন, তাদের দান খয়রাত করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন এবং দান করার ফজিলত বর্ণনা করতেন; যাতে তাদের অন্তর বিগলিত ও উৎসাহী হয়। রাসূল (ﷺ) তাদের ভিক্ষা করা হতে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করেন। তাদের জন্য ধৈর্য ধারণ ও কানায়াত করার গুরুত্ব আলোচনা করতেন। যেসব ইবাদতে অধিক সাওয়াব ও বিনিময় রয়েছে, তার প্রতি তাদের যত্নবান হওয়ার তালীম দেন। রাসূল (ﷺ) আসমান থেকে অবতীর্ণ ওয়াহ্‌য়ীর সাথে সম্পৃক্ত করতেন। তিনি নিজে তাদের পড়ে শোনাতেন এবং তাদের থেকে তিনি শুনতেন। যাতে এ শিক্ষার মাধ্যমে তাদের উপর দা‘ওয়াতের যে দায়িত্ব রয়েছে, তার অনুভূতি জাগ্রত হয়।

আর রাসূল (ﷺ) এভাবেই ধীরে ধীরে তাদের চারিত্রিক উ কর্ষ সাধন করেন এবং তাদের একটি মান-সম্পন্ন জাতিতে পরিণত করেন। যার ফলে তারা কিয়ামত অবধি মানবতার জন্য একটি আদর্শে পরিণত হন। এভাবে রাসূল (ﷺ) এর আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে ইতিহাসে একটি আদর্শবান ও উন্নত মানের মুসলিম সমাজ বিনির্মাণ করতে তিনি সক্ষম হন। সাথে সাথে জাহিলি সমাজের যাবতীয় সমস্যার বিজ্ঞান সম্মত সমাধান তিনি জাতির সামনে পেশ করেন এবং তা বাস্তবায়ন করে দেখান। ফলে অন্ধকারাচ্ছন্ন জাহিলি সমাজ ব্যবস্থা মানবতার জন্য একটি উন্নত আদর্শের দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী পরিণত হয়। এগুলো সবই হল, আল্লাহ তা‘আলার অপার অনুগ্রহ তারপর রাসূল (ﷺ) এর আন্তরিক প্রচেষ্টার সুফল। যারা আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করবে তাদের উচিত হল, রাসূল (ﷺ) এর সুন্নতের অনুসরণ করা এবং তার অনুসৃত পথে চলা। ()দেখুন: রাহীকুল মাখতুম ১৮৩।

 পাঁচ. মুহাজির ও আনছারদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন ও ইহুদীদের সাথে সম্পর্ক চিহ্ন করা:
আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করার পর, তিনি তাদের সাথে এমন একটি চুক্তি সম্পন্ন করেন, যাদ্বারা জাহিলিয়্যাতের সব ধরনের কু-সংস্কার, জাতিগত বৈষম্য, আঞ্চলিকতা, বর্ণ বৈষম্য, ভাষাগত বৈষম্য ও পারস্পরিক বিভেদ দূর হয়ে যায়। জাহিলিয়্যাতের অন্ধানুকরণের দরুন যে সব বিশৃংখলা, অন্যায় ও অনাচার সমাজে সংঘটিত হত, এ ধরনের সব অবকাশ দূর হয়ে যায়। এ চুক্তিতে মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে পরস্পরিক বন্ধন স্থাপন করার সাথে সাথে ইহুদীদের সাথে যাবতীয় সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন ও মদিনায় তাদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। উম্মতের সংশোধন ও তাদের ভিত্তি মজবুত করার জন্য এটি ছিল, রাসূল (ﷺ) এর প্রচেষ্টার স্পষ্ট ফলাফল। রাসূল (ﷺ) আনসার ও মুহাজিরদের মাঝে একটি লিপিবদ্ধ চুক্তি করেন, তাতে তিনি ইহুদীদের সাথে সম্পর্ক চিহ্ন করেন। রাসূল (ﷺ) তাদের সাথে যে চুক্তি করেন, তাতে তিনি তাদেরকে তাদের সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করেন এবং তাদের পক্ষে ও বিপক্ষে কিছু শর্তারোপ করেন।)আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ ২২৪-২২৬/২, যাদুল মায়াদ ৬৫/৩, সীরাতে ইবনে হিশাম ১২৩-১১৯/২।

এ চুক্তি ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম, সু-চিন্তিত, সু-কৌশল ও রাসূল (ﷺ) এর পক্ষ হতে বিশেষ একটি কৌশলিক বার্তা ও পরিপূর্ণ হিকমত। রাসূল (ﷺ) মদিনার সব মুসলিমদের এবং ইহুদীদের মধ্যে একটি সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। যার ফলে তারা একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত হল এবং একটি শক্তিতে পরিণত হল, ইচ্ছা করলে কেউ এখন আর মদিনায় আক্রমণ চালাতে পারবে না। কেউ মদিনার উপর আক্রমণ চালাতে চাইলে, এখন তারা তা প্রতিহত করতে সক্ষম।

রাসূল (ﷺ) যে পাঁচটি পদক্ষেপ নেন তা দ্বারা আল্লাহর অনুগ্রহে মদিনার অধিবাসীদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং তাদের মধ্যে দীর্ঘ কালের যে মত পার্থক্য ছিল তা দূর করতে সক্ষম হয়। রাসূল (ﷺ) মদিনা যে পাঁচটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা হল, মসজিদ নির্মাণ, ইহুদীদের ইসলামের দিকে আহ্বান করা, মুমিনদের মধ্যে সু-সম্পর্ক কায়েম করা ও তাদের তালীম তরবিয়ত দেয়া এবং অমুসলিমদের সাতে চুক্তি সম্পাদক করা।

এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে, রাসূল (ﷺ) এর ঐতিহাসিক এ পাচটি পদেক্ষপ ছিল যুগান্তকারী ও সময় উপযোগি। এ সব পদক্ষেপের মাধ্যমে রাসূল (ﷺ) এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতারই বহি: প্রকাশ ঘটে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদের অতীতের সমস্ত কু-সংস্কার দূর করে দেন, মুসলিমদের অন্তরসমূহকে এক জায়গায় একত্র করে এবং মদিনার অভ্যন্তরে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অগ্রণি ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়েও বহি:শত্রুর আক্রমণ ও তাদের হাত থেকে মদিনার নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। এ কারণে এ সনদটি পৃথিবীর ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সনদে পরিণত হয়। এ সনদের কারণেই আল্লাহর দিকে মানুষকে ডাকার বিষয়টি মদিনা থেকে সমগ্র দুনিয়াতে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ চুক্তি ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম, সু-চিন্তিত, সু-কৌশল ও রাসূল (ﷺ) এর পক্ষ হতে বিশেষ একটি পরিপূর্ণ হিকমত। রাসূল (ﷺ) মদিনার সব মুসলিমদের এবং ইহুদীদের মধ্যে এ সনদের মাধ্যমে একটি সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। যার ফলে তারা একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত হয় এবং একটি শক্তিতে পরিণত হয়। অবস্থা এখন এ পর্যায়ে পৌছে যে, ইচ্ছা করলে কেউ এখন আর মদিনায় আক্রমণ চালাতে পারবে না; মদীনায় আক্রমণ চালাতে হলে তাকে ভেবে চিন্তে এগুতে হবে। কেউ মদীনার উপর আক্রমণ করতে চাইলে, এখন তারা তা প্রতিহত করতে সক্ষম। রাসূল (ﷺ) যে পাঁচটি পদক্ষেপ নেন তা দ্বারা আল্লাহর অনুগ্রহে মদিনার অধিবাসীদের মধ্যে ঐতিহাসিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তাদের মধ্যে দীর্ঘ কালের যে মত পার্থক্য ছিল, রাসূল (ﷺ) তার এ ঐতিহাসিক সনদের মাধ্যমে তা দূর করতে সক্ষম হন। ()আর রাহীকুল মাখতুম ১৭৮, ১৭১,১৮৫ হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব: ১৭৪, ১৭৬ তারিখে ইসলামী ১৭৩/২ তারিখে ইসলামী ১৬৬/২

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ:
 যুদ্ধের ময়দানে রাসূল (ﷺ) এর সুন্দর প্রস্তুতি, সাহসিকতা ও বীরত্বের হিকমত সংক্রান্ত আলোচনা:
মদিনায় রাসূল (ﷺ) এর প্রচেষ্টায় একটি ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার পর তা মুসলিমদের জন্য একটি শক্তিশালী ঘাটিতে পরিণত হল। এ ছাড়াও মদিনা এখন মুসলিমদের জন্য একটি প্রাণ কেন্দ্র ও রাজধানীতে রূপান্তরিত হল। আর আতঙ্ক হল তাদের জন্য যারা ইসলামের অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করতে চায় এবং ইসলামী রাজধানীর ক্ষতি চায়। তাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও মদিনা মুসলিমদের জন্য আশ্রয়স্থল ও মিলন কেন্দ্র পরিণত হয়; এখান থেকে ইসলামের শত্রুদের প্রতিহত করার একটি সুযোগ মুসলিমদের তৈরি হয়। এ ধরনের অর্জনের পর রাসূল (ﷺ) আল্লাহর রাহে অন্তর দিয়ে ও মুখ দিয়ে কাফের মুশরিকদের সাথে যুদ্ধের ঘোষণা দেন। দা‘ওয়াত, বয়ান, তলোয়ার, ও অস্র দিয়ে যুদ্ধ করতে তার নিকট এখন আর কোন বাধা রইল না। তাই তিনি কাফেরদের বিরুদ্ধে সব ধরনের যুদ্ধ বিদ্রোহ পরিচালনা আরম্ভ করেন। তিনি ৫৬টি সৈন্যদল শত্রুর বিরুদ্ধে পাঠান এবং তিনি নিজেই সাতাশটি যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দেন। ()বুখারি ,কিতাবুল মাগাযি:৩৯৪৯, মুসলিম কিতাবুল জিহাদ ওয়াসসিয়ার: ১২৫৪, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২৪১/৩, যাদুল মা‘য়াদ ৫/৩

 যুদ্ধের ময়দানে রাসূল (ﷺ) কয়েকটি হিকমতপূর্ণ আচরণ:
এক. বদর যুদ্ধে রাসূল (ﷺ) এর আচরণ:
বদরের যুদ্ধ ছিল ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণের এ যুদ্ধের ভূমিকা অপরিসীম। এ যুদ্ধ ছিল নিরস্র মুষ্টিময় মুসলিমদের অস্র সস্রে সজ্জিত একটি সংখ্যাগরিষ্ট জামাতের বিরুদ্ধে লড়াই করা। এ কারণে এ যুদ্ধে মুসলিমদের সাথে বুদ্ধি পরামর্শ করা তাদের মতামত নিয়ে যুদ্ধে নামার গুরুত্ব ছিল রাসূল (ﷺ) এর নিকট অনিবার্য বাস্তবতা। তাই এ যুদ্ধে প্রথমেই রাসূল (ﷺ) আনসারীদের মতামত জানার জন্য মুসলিমদের নিকট পরামর্শ চান। কারণ, তারা রাসূল (ﷺ) কে মদিনা অভ্যন্তরে জান-মাল ও সন্তানদের নিরাপত্তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু মদিনার বাইরে তারা তাদের দায়িত্ব নেয়ার বিষয়ে কোন প্রতিশ্রুতি ইতিপূর্বে দেননি। রাসূল (ﷺ) প্রথমে মুসলিমদের সবাইকে একত্র করে তাদের সবার মতামত জানতে চান। একারণে রাসূল (ﷺ) তাদের সকলকে একত্র করলে, প্রথমে আবুবকর ও উমর (রাঃ) অত্যন্ত সুন্দরভাবে তাদের নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন। রাসূল (ﷺ) তাদের কথা ধৈর্য সহকারে শোনেন। কিন্তু শুধু তাদের কথার উপর রাসূল (ﷺ) সন্তুষ্ট থাকতে না পারায় তিনি আবারো সবার পরামর্শ চাইলেন। তারপর মিকদাদ (রাঃ) দাড়িয়ে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে আল্লাহ তা‘আলা যা করার নির্দেশ দিয়েছে, তা চালিয়ে যান, আমরা আপনার সাথে আছি। আর আমরা বনী ইসরাইল মুসা (আঃ) কে যা বলছে, যাও তুমি ও তোমার রব যুদ্ধ কর, আমরা এখানে বসে থাকব, এ ধরনের কথা আমরা বলব না। আমরা বলব, যাও তুমি ও তোমার রব যুদ্ধ কর, আমরাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করব। আমরা তোমার ডান, বাম, সামনে, পিছনে সবদিক দিয়ে তোমার সাথে যুদ্ধ করব। রাসূল (ﷺ) আবারো পরামর্শ চাইলে সা‘য়াদ ইবনে মুয়ায তাড়াতাড়ি দাড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি মনে হয় আমাদের থেকে শুনতে চান এবং আমাদের মতামত জানতে চান। মূলত: রাসূল (ﷺ) তাদের থেকেই শোনতে চাইতে ছিলেন। সা‘য়াদ (রাঃ) তাকে বলল, আপনি আশংকা করছেন আমরা শুধু মদিনার ভিতরে আপনার সহযোগিতা করবো এবং মদীনার ভিতরেই আপনাদের থেকে প্রতিহত করবো। আমি আনসারীদের পক্ষ থেকে আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি যে, আপনি যেখানে চান সৈন্য পাঠান, যাকে কাটতে চান বা জোড়া লাগাতে চান আমাদের কোন আপত্তি নাই। আমাদের সম্পদ থেকে আপনি যা চান নেন, আর যা চান আমাদের দেন। আপনি আমাদের থেকে যা নিলেন, তা আমাদেরকে যা দিলেন তার থেকে অধিক পছন্দনীয়। আপনি আমাদের কোন সিদ্ধান্ত দিলে আমাদের সিদ্ধান্ত আপনার সিদ্ধান্তের অনুসারী। আল্লাহর শপথ করে বলছি! যদি আপনি আমাদের নিয়ে গামদান যান আমরা আপনার সাথে থাকবো। আরও শপথ করে বলছি! আপনি যদি আমাদের এ সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেন, আমরা আপনার সাথে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ব। আমাদের থেকে একজন লোককেও পিছু হটতে পাবেন না। আগামী দিন আমরা দুশমনের মোকাবেলা করাকে কোন ক্রমেই অপছন্দ করছি না। আমরা যুদ্ধে ধৈর্যশীল, দুশমনের সাথে মোকাবেলা করতে বিশ্বাসী। হতে পারে আল্লাহ তা‘আলা আমাদের থেকে আপনাকে এমন কিছু দেখাবে, যা আপনার চোখকে শীতল করবে। আপনি আমাদের সাথে নিয়ে আল্লাহর নামের বরকতে আরম্ভ করেন। এ কথা শোনার পর রাসূল (ﷺ) এর চেহারা হাস্যজ্জল হয়ে যায়, তার অন্তর খুশি হয়ে যায় এবং কর্ম উদ্যম আরও বেড়ে যায়। তারপর তিনি বলেন,
«سيروا وأبشروا، فإن اللَّه قد وعدني إحدى الطائفتين، ولكأني الآن أنظر إلى مصارع القوم»
অর্থ, তোমরা চল, আর সুসংবাদ গ্রহণ কর। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে একটি জামাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে আমি কওমের বড় বড় লোকদের পড়ে থাকার স্থানগুলো দেখে নিচ্ছি। ()()আল বিদায়া নেহায়া: ২১৪/৩, সীরাতে ইবনে হিশাম: ২৫৩/২, যাদুল মায়াদ ১৭৩/২, রাহীকুল মাখতুম ২০০, হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব: ১৭৫ তারিখে ইসলামী ১৯৪/২

রাসূল (ﷺ) এর হিকমত হল, তিনি শুধু আসবাব বা মাধ্যমের উপর তাওয়াক্কুল করেননি, তিনি আল্লাহর উপরই তাওয়াক্কুল করেন, তবে আসবাব ও মাধ্যমকেও তিনি একেবারে ছেড়ে না দিয়ে তাও অবলম্বন করেন।

ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বলেন, বদর যুদ্ধের দিন রাসূল (ﷺ) মুশরিকদের দিকে দেখেন তখন তাদের সংখ্যা ছিল এক হাজার আর তার সাথীদের সংখ্যা ছিল মাত্র তিনশত তের জন। এ অবস্থা দেখে রাসূল (ﷺ) কেবলা মুখ হয়ে দু হাত তুলে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতে থাকেন। তিনি আল্লাহর নিকট কেদে কেদে বলেন, «اللَّهم أنجز لي ما وعدتني، اللَّهم إن تهلك هذه العصابة من أهل الإسلام لا تعبد في الأرض» হে আল্লাহ! তুমি আমাকে যে ওয়াদা দিয়েছে, তা পূরণ কর। হে আল্লাহ ! মুসলিমদের এ ক্ষুদ্র জামাতটিকে যদি তুমি ধ্বংস কর, তাহলে জমিনে তোমার নাম নেয়ার মত আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। এভাবে তিনি কিবলামুখি হয়ে আল্লাহর দরবারে দু হাত তুলে কান্নাকাটি করতে ছিলেন। কান্নাকাটি করতে করতে তার ঘাড় হতে চাদর পড়ে গেলে, আবু বকর (রাঃ) এসে তার ঘাড়ের উপর চাদরটি উঠিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর সাথে আপনার মুনাজাত যথেষ্ট হয়েছে! তিনি অবশ্যই আপনাকে যে ওয়াদা দিয়েছে তা পূরণ করবে। তারপর আল্লাহর এ আয়াত নাযিল হয়
﴿إِذۡ تَسۡتَغِيثُونَ رَبَّكُمۡ فَٱسۡتَجَابَ لَكُمۡ أَنِّي مُمِدُّكُم بِأَلۡف مِّنَ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ مُرۡدِفِينَ﴾[الأنفال:9]
অর্থ, আর স্মরণ কর, যখন তোমরা তোমাদের রবের নিকট ফরিয়াদ করছিলে, তখন তিনি তোমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন যে, নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে পর পর আগমনকারী এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করছি।সূরা আনফাল আয়াত: ৯।আল্লাহ তা‘আলা এ যুদ্ধে ফেরেশতাদের মাধ্যমে মুসলিমদের সাহায্য করেন। ()বুখারি ৩৯৫২ মুসলিম কিতাবুল জিহাদ ১৭৬৩, রাহিকুল মাখতুম ২০৮।

তারপর রাসূল (ﷺ) হুজরা থেকে এ কথা বলতে বলতে বের হন,
﴿سَيُهۡزَمُ ٱلۡجَمۡعُ وَيُوَلُّونَ ٱلدُّبُرَ﴾ [القمر:45 ]
অর্থ, সংঘবদ্ধ দলটি শীঘ্রই পরাজিত হবে এবং পিঠ দেখিয়ে পালাবে। সুরাতুল কামার আয়াত ৪৫ বুখারি হাদীস নং ৩৯৫৩।

রাসুল (ﷺ) শুধু দোয়া করেই ক্ষান্ত ছিলেন না তিনি বীরত্বের সাথে কাফেরদের মোকাবেলা করেন। যেভাবে তিনি দোয়া করতে গিয়ে না ছোঁড় বান্দা ছিলেন যুদ্ধেও তার অবস্থা ছিল তাই। তার সাথে আবু বকর (রাঃ) ছিলেন, তারা উভয়ে একদিকে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটিতে সবার চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন অনুরুপভাবে তারা উভয়ে যুদ্ধের ময়দানেও ছিলেন সবার অগ্রভাগে। তারা উভয়ে যুদ্ধের ময়দানে মুসলিমদের সাহস যোগাতে থাকেন তাদের যুদ্ধের ময়দানে উৎসাহ প্রদান করতে থাকেন। তারা তাদের নিজ নিজ অবস্থানে থেকে স্বশরীরে যুদ্ধ করতে থাকেন।
« فعن علي بن أبي طالب قال: <لقد رأَيْتُنَا يوم بدر، ونحن نلوذ برسول اللَّه صلى الله عليه وسلم وهو أقربنا إلى العدو، وكان من أشد الناس يومئذ بأساً ()».
অর্থ, আলী ইবনে আবী তালেব (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, বদরের দিন আমরা রাসূল (ﷺ) এর নিকট আসতাম তখন আমরা তাকে দেখতে পেতাম সে আমাদের চেয়েও দুশমনের মোকাবেলায় অধিক অগ্রসর। আর তিনি সেদিন আমাদের মধ্য হতে সর্বাধিক আঘাত প্রাপ্ত ছিলেন। আহমাদ ৮৬/১ হাকিম ১৪৩/২।

« وعنه قال: كنا إذا حمي البأس، ولقي القومُ القومَ اتقينا برسول اللَّه صلى الله عليه وسلم فلا يكون أحدنا أدنى إلى القوم منه»
অর্থ, আলী (রাঃ) হতে আরও বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা যখন আঘাত প্রাপ্ত হতাম এবং উভয় সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলত, তখন আমরা রাসূল (ﷺ) এর নিকট আসতাম বাচার জন্য তখন আমরা দেখতে তিনি আমাদের চাইতে আরও বেশি আক্রান্ত। ()হাকিম ১৪৩/২, বিদায়া নিহায়াতে ২৭৯/২ আল্লামা ইবনে কাসীর নাসায়ীর দিক নিসবত করেন

 দুই. ওহুদের যুদ্ধে রাসূল (ﷺ)-এর ত্যাগ ও বীরত্ব:
রাসূল (ﷺ) ওহুদের যুদ্ধেও অত্যন্ত সাহসিকতা ও ধৈর্যের পরিচয় দেন। এ যুদ্ধে তার স্বজাতি লোকেরা তাকে যে কষ্ট দেয় তার উপর তিনি ধৈর্য ধারণ করেন এবং তিনি কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠিন যুদ্ধ করেন। এ যুদ্ধে প্রথমে বিজয় মুসলিমদের হাতে ছিল, মুশরিকরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এমনকি তারা পালাতে পালাতে তাদের নারীদের নিকট পৌছে যায়। এ দিকে মুসলিম তীরান্দাজরা যখন তাদের পরাজয় দেখতে পেল তারা- মুসলিমরা- মনে করছিল, কাফেররা আর ফেরত আসবে না। তাই তারা রাসূল (ﷺ) যে স্থানের হেফাজত করার নির্দেশ দিয়েছিন তা রক্ষার করার চিন্তা বাদ দিয়ে স্থান ত্যাগ করে। তারা মনে করছিল মুশরিকরা আর ফিরে আসবে না। তাই তারা গণিমতের মালামাল একত্র করার জন্য যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং পাহাড়ের পাহারা ছেড়ে দেয়। মুশরিকরা যখন দেখতে পেল, মুসলিমদের নিরাপত্তা বেষ্টনী এখন আর নাই এবং তীরান্দাজ যোদ্ধারা পাহাড় থেকে গিয়ে গণিমতের মালামাল একত্র করতে ময়দানে নেমে গেছে। তাই তারা কোন প্রকার কাল ক্ষেপন না করে, ফিরে এসে মুসলিমদের ঘেরাও করে ফেলল এবং তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। ফলে এ যুদ্ধে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের সত্তর জন সাহাবীকে শাহাদাতের মর্যাদা দান করলেন। মুশরিকরা আক্রমণ করতে করতে রাসূল (ﷺ) পর্যন্ত পৌঁছে গেল, তারা তার চেহারাকে আঘাত করল, তার চারটি দাঁত ভেঙ্গে ফেলল, তার মাথার উপর আঘাত হানল। কতক সাহাবী জীবনবাজি রেখে তার থেকে দুশমনের আঘাত প্রতিহত করল। ()দেখুন: যাদুল মা`য়াদ ১৯৬/৩, রাহীকুল মাখতুম ২৫৫।

রাসূল (ﷺ) এর আশপাশে কুরাইশের দুই এবং আনসারের সাতজন লোক ছিল। যখন মুশরিকরা রাসূল (ﷺ) কে তীর মারতে ছিল এবং নিকটে পৌঁছে গেল, তখন রাসূল (ﷺ) বললেন,
« من يردهم عنا وله الجنة، أو هو رفيقي في الجنة[، فتقدم رجل من الأنصار فقاتل حتى قتل، ثم رهقوه أيضاً فقال: ]من يردهم عنا وله الجنة،[ فتقدم رجل من الأنصار فقاتل حتى قتل، فلم يزل كذلك حتى قتل السبعة، فقال رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم لصاحبيه: [ما أنصفنا أصحابنا»
অর্থ, যে আমার থেকে তাদের প্রতিহত করবে তার জন্য অবশ্যই জান্নাত অথবা জান্নাতে সে আমার সাথী হয়ে থাকবে। এ কথা শোনে একজন আনছারী সাহাবী সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন। তারপর তারা আবারো তীর নিক্ষেপ করতে থাকলে রাসূল (ﷺ) বলেন, যে আমার থেকে তাদের প্রতিহত করবে তার জন্য অবশ্যই জান্নাত অথবা জান্নাতে সে আমার সাথী হবে। এ কথা শোনে অপর একজন আনসারী সাহাবী সামনে অগ্রসর হয়ে যুদ্ধ করতে থাকে অবশেষে সেও শহীদ হয়। তারপর তারা আবারো তীর নিক্ষেপ করতে থাকলে রাসূল (ﷺ) বলেন, যে আমার থেকে তাদের প্রতিহত করবে তার জন্য অবশ্যই জান্নাত অথবা জান্নাতে সে আমার সাথী হবে।মুসলিম কিতাবুল জিহাদ হাদীস নং ১৭৮৯। () এ কথা শোনে একজন আনসারী সামনে অগ্রসর হয়ে যুদ্ধ করতে করতে সেও শহীদ হয়। তারপর তারা আবারো তীর নিক্ষেপ করতে থাকলে রাসূল (ﷺ) বলেন, যে আমার থেকে তাদের প্রতিহত করবে সে অবশ্যই জান্নাতি অথবা জান্নাতে সে আমার সাথী হবে। এভাবে চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সাতজন সাহাবী শহীদ হয়। তখন রাসূল (ﷺ) তার দুই সাথীকে বলল, আমাদের সাথীরা আমাদের সাথে যে কাজটি করেছে তা মোটেই ঠিক করেনি।

আর যখন মুসলিমরা রাসূল (ﷺ) কে ঘিরে একটি দুর্গে একত্র হল, রাসূল (ﷺ) উবাই ইবনে খলফ তার একটি ঘোড়ার আরোহণ অবস্থায় পাহাড়ের প্রান্তে রাসূল (ﷺ)কে দেখতে পেয়ে বলল, মুহাম্মাদ কোথায় ? সে যদি নাজাত পায়, তা হলে আমার কোন নাজাত নাই। তার কথা শোনে লোকেরা বলল, আমাদের কেউ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে? রাসূল (ﷺ) বললেন, না তাকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দাও। তারপর যখন সে রাসূল (ﷺ) এর আক্রমণের জন্য সামনের দিক অগ্রসর হচ্ছিল, রাসূল (ﷺ) হারেস ইবনে সাম্মাহ (রাঃ) হতে একটি লাটি নিয়ে তার দিকে ছুড়ে মারল। এতেই উবাই ইবনে খলফের অবস্থা খারাব হয়ে গেল। সে যখন তার স্বজাতির নিকট ফিরে যায় তখন সে বলে আল্লাহর শপথ! আমাকে মুহাম্মদ হত্যা করে ফেলছে। তখন তারা তাকে বলল, তুমি খামাখা ভয় পাচ্ছ! আমরা তোমার মধ্যে কোন আঘাতই দেখতে পাচ্ছি না। তখন সে বলে, মুহাম্মদ মক্কা থাকা অবস্থায় একদিন আমাকে হত্যা করবে বলছিল, আল্লাহর কসম করে বলছি, সে যদি আমার দিকে একটু থু থু ও নিক্ষেপ করে আমার মৃত্যুর জন্য তাই যথেষ্ট হবে। তারপর আল্লাহ এ দুশমনটি মক্কা থেকে ফেরার পথে সারাফ নামক স্থানে মারা যায়। ()বিদায়া নেহায়া: ৩২/৪, , যাদুল মায়াদ ১৯৯/৩, রাহীকুল মাখতুম ২৬৩, তাবারী ৬৭/২ ফিকহুস সীরাহ ২২৬

« وعن سهل بن سعد أنه سُئلَ عن جرح النبي صلى الله عليه وسلم يوم أحد فقال: جُرحَ وجه النبي صلى الله عليه وسلم وكُسرَت رباعيته، وهُشِمَت البيضة على رأسه، فكانت فاطمة – عليها السلام – تغسل الدم، وعليٌّ يمسك، فلما رأت أن الدم لا يرتد إلا كثرة أخذت حصيراً فأحرقته حتى صار رماداً، ثم ألزقته فاستمسك الدم. »
সাহাল ইবনে সাদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তাকে রাসূল (ﷺ) এর আঘাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলে, ওহুদের যুদ্ধে রাসূল (ﷺ) এর চেহারা মোবারক জখম হয়, তার রুবায়ী দাঁত ভেঙে যায় এবং তার মাথায় তীর আঘাত হানে। ফাতেমা (রাঃ) তার মাথা থেকে প্রবহমান রক্ত ধুইতেছিল আর আলী (রাঃ) রক্ত বন্ধ করতে চেষ্টা করছিল; তিনি যখন দেখতে পেলেন কোনোভাবেই রক্ত বন্ধ করা যাচ্ছে না তখন সে একটি চাটাই নিয়ে তাতে আগুন জালিয়ে ছাই বানায় এবং সেগুলোকে ক্ষত স্থানে মালিশ করার পর তার রক্ত বন্ধ হয়। ()বুখারি, কিতাবুল জিহাদ ২৯১১ মুসলিম কিতাবুল জিহাদ ১৭৯০।

এভাবেই রাসূল (ﷺ) কে দ্বীনের জন্য কাফের মুশরিকদের পক্ষ থেকে কষ্ট, নির্যাতন ও জুলুম সইতে হয়। তারপরও তিনি তার স্বজাতির বিরুদ্ধে কোন দিন বদ-দোয়া করেননি বরং তাদের জন্য তিনি আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কারণ, তারাতো জানে না।
« فعن عبد اللَّه بن مسعود قال: كأني أنظر إلى رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم يحكي نبياً من الأنبياء ضربه قومه وهو يمسح الدم عن وجهه، ويقول: ]اللَّهم اغفر لقومي فإنهم لا يعلمون».
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসূদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, আমি রাসুল (ﷺ) এর দিকে তাকিয়ে থাকলে তাকে দেখি তিনি আগেকার আমলের একজন নবীর বর্ণনা দেন যে, তার গোত্রের লোকেরা তাকে মেরে রক্তাক্ত করছে, আর সে তার চেহারা হতে রক্ত মুছতেছে। [এত নির্যাতন সত্বেও সে তার জাতির বিপক্ষে কোন বদ দোয়া করেনি।] সে বলতেছে হে আল্লাহ আপনি আমার কওমের লোকদের ক্ষমা করে দেন! কারণ, তারা বুঝেনা।() বুখারি, কিতাবুল আম্বিয়া হাদিস নং ৩৪৭৭, মুসলিম, কিতাবুল জিহাদ হাদীস নং ১৭৯২।

নবীরা তাদের উম্মতদের দা‘ওয়াত দিতে গিয়ে তাদের থেকে যেসব জুলুম নির্যাতনের স্বীকার হন তার উপর ধৈর্য ধারণ করা এবং সহনশীলতার পরিচয় দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের কোন দৃষ্টান্ত খুজে পাওয়া যাবে না। বিশেষ করে সমগ্র নবীদের সরদার মুহাম্মাদ (ﷺ) তিনি যে ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তারা শুধু ধৈর্য ধারনই করেননি, বরং তারা তাদের ক্ষমা করে দিতেন তাদের জন্য হিদায়েত ও মাগফিরাতের দোয়া করতেন। তাদের অপরাধকে এ বলে ক্ষমা করে দিতেন যে তারা জানে না। রাসূল (ﷺ) তখন বলেন,
« اشتد غضب اللَّه على قوم فعلوا هذا برسول اللَّه صلى الله عليه وسلم، [وهو حينئذ يشير إلى رباعيته، ]اشتد غضب اللَّه على رجل يقتله رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم في سبيل اللَّه تعالى »
অর্থ, রাসূল (ﷺ) তার রুবায়ী দাতের দিকে ইশারা করে বলেন, যে জাতি তাদের নবীর সাথে এ ধরনের আচরণ করে, তাদের উপর আল্লাহর আযাব অবধারিত। আর যাকে আল্লাহর রাহে কোন নবী বা রাসূল হত্যা করে তার উপর আল্লাহর আযাব অবধারিত।() বুখারি, কিতাবুল মাগাযি, হাদীস নং ৪০৭৩, মুসলিম, কিতাবুল জিহাদ ১৭৩৯।

ওহুদের যুদ্ধে রাসূল (ﷺ) যে আঘাত পেয়েছেন এবং জুলুম নির্যাতনের উপর যেভাবে ধৈর্য ধারণ করেছেন, আল্লাহর পথের দা‘ঈদের জন্য তা আজীবন আদর্শ হয়ে থাকবে। যারা আল্লাহর পথে দা‘ওয়াত দিতে গিয়ে জেল জুলুম, দৈহিক নির্যাতন, দেশান্তর হওয়া এবং সর্বশেষ তাদের জীবন কেড়ে নেয়া ইত্যাদির স্বীকার হয়ে থাকে তাদের জন্য রাসূল (ﷺ) হল উত্তম আদর্শ। কারণ, তাকে অনুরুপ অনেক কষ্টই দেয়া হয়েছে। আর তিনি তাতে ধৈর্য ধরেছেন।

 তিন. হুনাইনের যুদ্ধে রাসূল (ﷺ) এর হিকমত ও সাহসিকতা:
হুনাইনের যুদ্ধ ছিল মুসলিমদের জন্য একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ। এ যুদ্ধে রাসূল (ﷺ) এর বীরত্ব ও সাহসিকতা ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। রাসূল (ﷺ) এর বীরত্ব ও সাহসিকতার বদৌলতে এ যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয় নিশ্চিত হয়। অন্যথায় মুসলিমরা এ যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ফিরে আসতে হত।

হুনাইনের যুদ্ধে মুসলিম ও কাফেরদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হলে মুসলিমরা প্রথম অবস্থায় পিছু হটে পড়ে এবং দুর্বল ও কতক নতুন ইসলাম গ্রহণকারী কিছু নও মুসলিম পলায়ন করতে শুরু করে। রাসূল (ﷺ) ঐ মুহূর্তে কোন প্রকার ভয় না করে তিনি তার গাধাটিকে নিয়ে কাফেরদের মোকাবেলায় সামনের দিক অগ্রসর হতে থাকে। তারপর তিনি তার চাচা আব্বাসকে বলেন,
« أي عباس، ناد أصحاب السمرة[ فقال عباس: - وكان رجلاً صيتاً – فقلت بأعلى صوتي: أين أصحاب السمرة؟ قال: فواللَّه لكأن عَطْفَتهم حين سمعوا صوتي عَطْفَة البقر على أولادها، فقالوا: يا لبيك، يا لبيك، قال: فاقتتلوا والكفار... فنظر رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم وهو على بغلته كالمتطاول عليها إلى قتالهم، فقال صلى الله عليه وسلم: [الآن حمي الوطيس» মুসলিম, কিতাবুল জিহাদ ১৭৭৫।.
হে আব্বাস! তুমি সামুরাবাসীদের উচ্চ স্বরে ডাক দাও! আব্বাস (রাঃ) ঐ যুগে সবচেয়ে অধিক কন্ঠস্বরী ছিলেন। আবব্বাস (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ﷺ) এর নির্দেশ মোতাবেক উচ্চ আওয়াজে বললাম, হে আসহাবে সামুরা! তোমরা কোথায়? আব্বাস (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমার আওয়াজ শোনার পর গরুর বাছুর যেমন দড়ি ছেড়ে দিলে তার মায়ের নিকট দৌড়ে আসে ঠিক অনুরূপ يا لبيك، يا لبيك বলে সমগ্র সাহাবী রাসূল (ﷺ) দিকে দৌড়ে আসে। তারপর তারা কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকে। আর রাসূল (ﷺ) তার স্বীয় গাধায় আরোহণ অবস্থায় একজন বীর পুরুষের মত তাদের যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেন। তারপর রাসূল (ﷺ) বললেন,الآن حمي الوطيس হুনাইনের যুদ্ধের নাজুক পরিস্থিতিতে রাসূল (ﷺ) যে সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত বিরল। আজ পর্যন্ত এ ধরনের বীরত্ব ও সাহসিকতা কোন সেনাপতি, নেতা ও বীর বাহাদুর দেখাতে পারেনি। দেখুন:আর রাহিকুল মাখতুম ৪০১, হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব ৪০৮

বারা ইবনে আযেব (রাঃ) কে এক লোক জিজ্ঞাসা করে বলল, হে আবু উমারা তুমি হুনাইনের যুদ্ধের দিন পলায়ন করেছিলে? উত্তরে তিনি বলেন, না, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি! আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সেদিন পিছু হটেননি এবং কোন মুসলিম সেদিন পলায়ন করেননি। তবে যুবক ও তাড়াহুড়াকারী কিছু মুসলিম তাদের নিকট কোন অস্র না থাকাতে বা অস্রের পরিমাণ কম হওয়াতে তারা কিছুটা পিছু হটে। তারপর তারা একটি তীরন্দাজ সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে মোকাবেলা করে, তারা তাদের তীর নিক্ষেপ করতে থাকলে অবস্থা এমন দাঁড়ালো তাদের তীর যেন নিশানা ভুল করছিল না। পরে তাদের নিকট অবস্থা প্রকাশ পেলে, সবাই রাসূল (ﷺ) এর নিকট এসে জড়ো হয়ে থাকে। তখন আবু সুফিয়ান ইবনুল হারেস রাসূল (ﷺ) এর গাধার রশি টেনে ধরে থাকে, আর রাসূল (ﷺ) বলতে থাকে-
أنا النبي لا كذب
أنا ابن عبد المطلب
اللَّهم نزِّل نصرك
অর্থ, আমি সত্যিকার নবী তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই। আমি আব্দুল মুত্তালিবের উত্তরসূরি। হে আল্লাহ ! তুমি তোমার সাহায্য নাযিল কর। মুসলিম, কিতাবুল জিহাদ ১৭৭৬, বুখারি, কিতাবুল জিহাদ ২৯৩০।
« وفي رواية لمسلم عن سلمة قال: مررت على رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم منهزماً، وهو على بغلته الشهباء، فقال رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم: [لقد رأى ابن الأكوع فزعاً[. فلما غشوا رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم نزل عن البغلة، ثم قبض قبضة من تراب من الأرض، ثم استقبل به وجوههم، فقال: [شاهت الوجوه[، فما خلق اللَّه منهم إنساناً إلا ملأ عينيه تراباً بتلك القبضة، فولوا مدبرين، فهزمهم اللَّه ، وقسم رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم غنائمهم بين المسلمين. »
অর্থ, মুসলিম শরীফে সালমা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (ﷺ) কে পরাভূত অবস্থায় অতিক্রম করি। তখন তিনি তার ‘শাহবাহ‘ গাধাটির উপর ছিল। আমাকে দেখে রাসূল (ﷺ) বলল, আজ ইবনুল আকওয়া ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছে। তারপর যখন সাহাবীরা তাকে ঘেরাও করে ফেলল, তখন তিনি তার গাধা থেকে নেমে জমিন থেকে এক মুষ্টি মাটি নিলো। তারপর তা কাফেরদের দিকে নিক্ষেপ করে বলে, তোমাদের চেহারা আক্রান্ত হোক। তারপর আল্লাহ এমন কোন চেহারা সৃষ্টি করেননি যার চেহারা মাটির কারণে আক্রান্ত হয়নি। তারপর কাফেররা গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পরাজিত হয়ে পলায়ন করল। এরপর রাসূল (ﷺ) মুসলিমদের মধ্যে গণিমতের মালামাল বণ্টন করেন। ()মুসলিম, কিতাবুল জিহাদ ১৭৭৭।

ওলামাগণ বলেন, যুদ্ধের ময়দানে রাসূল (ﷺ)-এর গাধার উপর আরোহণ করা ছিল তার বীরত্ব ও সাহসিকতার বহি:প্রকাশ। এ ছাড়াও তিনি ঐ সময় মানুষের জন্য আশ্রয়স্থল ছিলেন। যার কারণে সবাই দৌড়ে তার দিকেই ছুটে আসে। তার সাহসিকতা ও বীরত্বের আরও প্রমাণ হল, তিনি এ নাজুক পরিস্থিতিতে দুশমনদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। অথচ তখন লোকেরা তাকে ছেড়ে পলায়ন করতেছিল। আর যখন তারা তাকে বেষ্টন করে ফেলল, তখন তিনি তার আরোহণ থেকে নেমে আসা তার অধিক সাহসিকতারই দৃষ্টান্ত। কেউ কেউ বলেন, তিনি তখন জমিনে নেমে আসে যে মুসলিম জমিনে ছিল তাদের সাথে একাত্বতা ঘোষণা করার জন্য ছিল। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) প্রতিটি ক্ষেত্রে যে সাহসিকতা ও বীরত্বের প্রমাণ রেখেছেন; ইতিহাসে এর আর কোন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া কঠিন। রাসূল (ﷺ) এর সাহাবীরা তার বীরত্বের বিভিন্ন বর্ণনা তুলে ধরেন। দেখুন : নববীর শরহে মুসলিম ১১৪/১২।

 চার. রাসূল (ﷺ) এর হিকমত ও সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশের আরেকটি নমুনা:
বুখারি ও মুসলিমে আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
« قال: كان النبي صلى الله عليه وسلم أحسن الناس، وأجود الناس، وأشجع الناس، ولقد فزع أهل المدينة ذات ليلة، فانطلق الناس قَبِلَ الصوت، فاستقبلهم النبي صلى الله عليه وسلم قد سبق الناس إلى الصوت، وهو يقول: [لم تراعوا، لم تراعوا[، وهو على فرس لأبي طلحة عري ما عليه سرج، في عنقه سيف، فقال: [لقد وجدته بحراً[، أو [إنه لبحر. »

রাসূল (ﷺ) সর্বাধিক সুন্দর, দানশীল ও সাহসী পুরুষ ছিলেন। একবার রাতে মদিনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে লোকেরা ঘুম থেকে উঠে যেখানে চিৎকার শোনা যাচ্ছে সেদিকে দৌড়ে যাচ্ছিল। সেখানে গিয়ে দেখে রাসূল (ﷺ) তাদের সবার আগে সেখানে আবু তালহার একটি ঘোড়ার উপর আরোহণ করে গলায় একটি তলোয়ার ঝুলিয়ে উপস্থিত। ঘোড়াটির কোন চাদর বা জ্বীনপোশ ছিল না। তিনি সেখানে লোকদের ডেকে ডেকে বলছিল [لم تراعوا، لم تراعوا]। তোমরা ঘাবড়াবেনা, তোমরা ঘাবড়াবে না।()মুসলিম, কিতাবুল ফাজায়েল। অতপর সে বলল, আমি তাকে পেলাম সমুদ্র অথবা তিনি একটি সমুদ্র।

রাসূল (ﷺ) এর জীবনীতে এ ধরনের ঘটনা আরও অনেক আছে, যা এখানে আলোচনা করে শেষ করা সম্ভব নয়। তবে এ ধরনের ঘটনা দ্ধারা এ কথা স্পষ্ট হয় যে রাসূল (ﷺ) ছিলেন দুনিয়ার সব মানুষের তুলনায় একজন সাহসী বীর পুরুষ। তারমত সাহসী ও বাহাদূর ব্যক্তি ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। এটি শুধু মুখের কথা নয়, বরং দুনিয়াতে আজ পর্যন্ত যত বীর বাহাদুর ও সাহসী লোক অতিবাহিত হয়েছে, তারা এ বিষয়ে সাক্ষী দিয়ে গেছেন এবং রাসূল (ﷺ) কে স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন।মুসনাদে আহমাদ ৮৬/১ হাকিম ১৪৩/২। ()
« قال البراء كنا واللَّه إذا احمر البأس نتقي به، وإن الشجاع منا للذي يحاذي به، يعني النبي صلى الله عليه وسلم. »
অর্থ, বারা ইবনে আযেব (রাঃ) বলেন, যখন কোন বিপদ আমাদের ঘিরে ফেলত, তখন আমরা রাসূল (ﷺ) দ্বারা আত্মরক্ষা করতাম। আর আমাদের মধ্যে সাহসী ব্যক্তি সেই হত, যে রাসূল (ﷺ) এর সমপর্যায়ের হত। ()মুসলিম ১৪০১/৩।

পূর্বে উল্লেখিত হাদিসে আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন.
«كان النبي صلى الله عليه وسلم أحسن الناس، وأجود الناس، وأشجع الناس.. ».
রাসূল (ﷺ) সর্বাধিক সুন্দর, দানশীল ও সাহসী পুরুষ ছিলেন...।

উপরে যেসব দৃষ্টান্ত আলোচনা করা হয়েছে, তা ছিল রাসূল (ﷺ)-এর মনোবল সাহসিকতার দৃষ্টান্ত। কিন্তু তার বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতা বিষয়ে অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। আমরা এখানে তার জীবনী হতে একটি মাত্র ঘটনা উল্লেখ করব। এ একটি ঘটনাই হাজারের বেশি ঘটনা আলোচনার প্রয়োজন মিটিয়ে দেবে।

হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় সুহাইল ইবনে আমরের হঠকারীতা। কারণ, রাসূল (ﷺ) যখন بسم اللَّه الرحمن الرحيم লিখতে চাইলেন, তখন সে বাধা দিলে তা পরিবর্তন করে بسمك اللَّهم লিখেন। অনুরূপভাবেمحمد رسول اللَّه এর পরিবর্তে محمد بن عبد اللَّه লিখেন। এ ছাড়াও সুহাইল ইবনে আমর মুসলিমদের বিরুদ্ধে যত ধরনের শর্তারোপ করেছিল, যেমন- মক্কা থেকে কোন একজন লোকও যদি মদীনায় পালিয়ে আসে যদিও সে ইসলাম গ্রহণ করে তাকে অবশ্যই মক্কায় কাফেরদের নিকট ফের পাঠাতে হবে। রাসূল (ﷺ) মুসলিমদের বিপক্ষে দেয়া সব শর্তই কোন প্রকার আপত্তি না তুলে মেনে নেন। রাসূল (ﷺ) এর এ অবস্থা দেখে মুসলিমরা ক্রোধে ও ক্ষোভে অগ্নিশর্মা হয়ে পড়ে। কিন্তু রাসূল (ﷺ) এর সিদ্ধান্তের বাইরে তাদের কিছু করার ছিল না। রাসূল (ﷺ) নীরবে সয়ে গেলেন এবং ধৈর্য ধারণ করলেন। আল্লাহর কি কুদরত! অতি নিকটেই কিছুদিন যেতে না যেতে মুসলিমরা রাসূল (ﷺ) এর ধৈয্যের্র ফলাফল দেখতে পেল। এ চুক্তি মেনে নেয়াতে মুসলিমদের বিজয় নিশ্চিত হল। আল্লাহ তা‘আলা এ সন্ধিকে মুসলিমদের জন্য প্রকাশ্য বিজয় হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। ()দেখুন: বুখারি মায়াল ফাতহ ৩২৯/৫, হাদীস নং- ২৭৩১, ২৭৩২, মুসনাদে আহমদ ৩৩১-৩২৮/৪, হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব ৫৩২।

উপরে রাসূল (ﷺ) সাহসিকতা বাহাদূরী অটল অবিচলতার ও ধৈর্যের যেসব ঘটনা উল্লেখ করা হল, এ গুলো সবই হলো তার ঘটনা সম্বলিত জীবন সমুদ্রের কয়েকটি ফোটা মাত্র। অন্যথায় তার জীবনের সব ঘটনা উল্লেখ করতে হলে বড় বড় বই লিখে তার কোন কিনারায় পৌছা যাবে না। আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে, আমরা সবাই যেন আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারই অনুকরণ করি এবং তার আদর্শকে সমুন্নত রাখি। তাহলে আমাদের জন্য দুনিয়াও আখিরাতের কল্যাণ নিশ্চিত হবে। বিশেষ করে আমরা যারা আল্লাহর পথে মানুষকে আহবান করি তারা যেন তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর আদর্শ ও তার অনুসৃত পথ হতে বিন্দু পরিমাণও এদিক সেদিক না হাটি। অন্যথায় আমাদের শত চেষ্টা ও আন্দোলন কোন কাজে আসবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَة لِّمَن كَانَ يَرۡجُواْ ٱللَّهَ وَٱلۡيَوۡمَ ٱلۡأٓخِرَ وَذَكَرَ ٱللَّهَ كَثِير ا﴾ [الأحزاب:21]
অর্থ, তোমাদের জন্য রাসূল (ﷺ) এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। যারা আল্লাহর ও আখেরাতের আশা করে এবং বেশি বেশি আল্লাহর স্মরণ করে।সুরা আহযাব আয়াত ২১।

আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে তার রাসূল এর অনুকরণ করা ও তার সুন্নতের বাস্তবায়নে আন্তরিক হওয়ার তাওফিক দান করুন।

 তৃতীয় পরিচ্ছেদ
ব্যক্তি-পর্যায়ে রাসূল (ﷺ) এর দাওয়াত দেওয়ার হিকমত ও কৌশল:
রাসূল (ﷺ) ছিলেন, আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টির সর্বাধিক জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান। তিনি মানুষের সাথে কখনোই কোন খারাপ ব্যবহার করেননি। তিনি সব সময় বিনম্র আচরণ ও ভালো ব্যবহার করতেন, যাতে তারা ইসলামের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়। ক্ষমা করা ছিল তার অন্যতম গুণ। মানুষের পক্ষ থেকে কোন কষ্ট দেয়া হলে, তার উপর তিনি ধৈর্য ধারণ করতেন এবং উত্তম ব্যবহার দ্বারা তা মোকাবেলা করতেন। তিনি কখনোই কারো থেকে প্রতিশোধ নিতেন না। রাসূল (ﷺ) এর ক্ষমা, দানশীলতা, নম্রতা, ভদ্রতা, ইনসাফ, ধৈর্য ও সহনশীলতা কেমন ছিল, নিম্নের কয়েকটি আলোচনা দ্বারা কিছুটা হলেও ফুটে উঠবে।
এক. ইয়ামামার অধিবাসীদের সরদার ছুমামা ইবনে আছাল (রাঃ) এর সাথে রাসূল (ﷺ) এর আচরণ:
বুখারি ও মুসলিমে আবু হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
« أنه قال: بعث رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم خيلاً قِبَلَ نجد، فجاءت برجل من بني حنيفة، يقال لـه ثمامة بن أُثال، سيد أهل اليمامة، فربطوه بسارية من سواري المسجد، فخرج إليه رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم فقال: [ماذا عندك يا ثمامة؟[ فقال: عندي يا محمد خير، إن تقتل تقتل ذا دم ، وإن تنعم تنعم على شاكر، وإن كنت تريد المال فسل تعط منه ما شئت، فتركه رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم حتى كان بعد الغد، فقال: [ما عندك يا ثمامة؟[ فقال: ما قلت لك، إن تنعم تنعم على شاكر، وإن تقتل تقتل ذا دم، وإن كنت تريد المال فسل تعط منه ما شئت، فتركه رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم حتى كان من الغد، فقال: [ماذا عندك يا ثمامة؟[ فقال: عندي ما قلت لك، إن تنعم تنعم على شاكر، وإن تقتل تقتل ذا دم، وإن كنت تريد المال فسل تعط منه ما شئت، فقال رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم: [أطلقوا ثمامة[, فانطلق إلى نخل قريب من المسجد، فاغتسل، ثم دخل المسجد فقال: <أشهد أن لا إله إلا اللَّه وأشهد أن محمداً عبده ورسوله، يا محمد! واللَّه ما كان على الأرض وجه أبغض إليَّ من وجهك، فقد أصبح وجهك أحبَّ الوجوه كلها إليَّ، واللَّه ما كان من دين أبغض إليَّ من دينك، فأصبح دينك أحبَّ الدين كله إليَّ، واللَّه ما كان من بلد أبغض إليَّ من بلدك، فأصبح بلدك أحب البلاد كلها إليَّ، وإن خيلك أخذتني وأنا أريد العمرة فماذا ترى؟ فبشره رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم، وأمره أن يعتمر، فلما قدم مكة قال لـه قائل: أصبوت؟ فقال: [لا واللَّه]، ولكني أسلمت مع رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم، ولا واللَّه لا يأتيكم من اليمامة حبة حنطة حتى يأذن فيها رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم».
অর্থ. রাসূল (ﷺ) নজদের দিকে একটি জামাত পাঠালে তারা ইয়ামামার অধিবাসীদের সরদার ছুমামা ইবনে আছাল নামে এক ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে আসে এবং মসজিদের খুঁটির সাথে বেধে রাখে। রাসূল (ﷺ) বের হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করল, হে ছুমামা তোমার কি বলার আছে?। তখন সে বলল, হে মুহাম্মদ! আমার নিকট কল্যাণ রয়েছে। যদি তুমি হত্যা কর, তাহলে এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করবে, যে হত্যাযোগ্য। আর যদি পুরস্কৃত কর, তাহলে এমন এক ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করবে, যে তোমার পুরস্কারের প্রতিদান দেবে। আর যদি তুমি সম্পদ চাও তাহলে বল, তোমাকে তা দেয়া হবে। রাসূল (ﷺ) তার কথার কোন প্রতি উত্তর না করে আগামী দিন পর্যন্ত তাকে সুযোগ দেন। পরের দিন রাসূল (ﷺ) তাকে বললেন, হে ছুমামা তোমার কি বলার আছে?। তখন সে বলল, আমি তোমাকে যা বলছি! যদি তুমি হত্যা কর, তাহলে এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করবে, যে হত্যাযোগ্য। আর যদি পুরস্কৃত কর, তাহলে এমন এক ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করবে, যে তোমার পুরস্কারের প্রতিদান দেবে। আর যদি তুমি সম্পদ চাও তাহলে বল, তোমাকে তা দেয়া হবে। রাসূল (ﷺ) তার কথার কোন প্রতি উত্তর না করে আবারো তাকে পরের দিন পর্যন্ত সুযোগ দেন। পরের দিন রাসূল (ﷺ) তাকে বললেন, হে ছুমামা তোমার কি বলার আছে?। সে বলল, আমি যা বলছি! যদি তুমি হত্যা কর, তাহলে এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করবে, যে হত্যাযোগ্য। আর যদি পুরস্কৃত কর, তাহলে এমন এক ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করবে, যে তোমার পুরস্কারের প্রতিদান দেবে। আর যদি তুমি সম্পদ চাও তাহলে বল, তোমাকে তা দেয়া হবে।

তারপর রাসূল (ﷺ) বললেন, তোমরা ছুমামাকে ছেড়ে দাও। ছুমামাকে ছেড়ে দিলে সে মসজিদের নিকটে একটি বাগানে গিয়ে গোসল করে, তারপর মসজিদে প্রবেশ করে এবং বলে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্যিকার ইলাহ নেই, আর আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (ﷺ) আল্লাহর বান্দা ও তার রাসূল। হে মুহাম্মদ! আমার নিকট তোমার চেহারার চেয়ে নিকৃষ্ট কোন চেহারা জমিনে ছিল না, আর এখন আমার নিকট তোমার চেহারা সমগ্র চেহারার চেয়ে প্রিয় চেহারায় পরিণত হয়েছে। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, তোমার দ্বীনের চেয়ে ঘৃণিত আর কোন দ্বীন ছিল না। আর এখন আমার নিকট তোমার দ্বীন সবচেয়ে বেশি প্রিয় দ্বীনে পরিণত হয়েছে। আল্লাহর শপথ করে বলছি! আমার নিকট তোমার শহর ছিল সবচেয়ে ঘৃণিত, আর এখন আমার তোমার এ শহর সবচেয়ে প্রিয় শহরে পরিণত হয়েছে। আর তোমার জামাত আমাকে পাকড়াও করে নিয়ে এসেছে, আমি ওমরা করতে চাই তুমি আমাকে কি পরামর্শ দাও। রাসূল (ﷺ) তাকে সু-সংবাদ দেন এবং ওমরা করার আদেশ দেন। সে যখন মক্কায় গমন করে, একজন তাকে বলল, তুমি দ্বীনছুট হলে? সে বলল, না আল্লাহর শপথ আমি রাসূল (ﷺ) এর সাথে ইসলাম গ্রহণ করেছি। আর আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, ইয়ামামার একটি গমের বীজও রাসূল (ﷺ) এর অনুমতি ছাড়া এদিক সেদিক করা হবে না। ()বুখারি, কিতাবুল মাগাযি: ৪৩৭২ মুসলিম: ১৭৬৪

তারপর সে ইয়ামামার দিকে চলে যায় এবং সেখান থেকে তিনি মক্কার দিকে কোন কিছু বহন করতে নিষেধ করেন। তারা রাসূল (ﷺ) এর নিকট চিটি লিখেন তুমি আমাদের আত্মীয়তা সম্পর্ক ঠিক রাখার নির্দেশ দাও, অথচ তুমি নিজে আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক বিচ্ছেদ কর। তুমি আমাদের বাপ-দাদাদের তলোয়ার দ্বারা হত্যা করছ! আর আমাদের ছেলে সন্তানদের ক্ষুধা দিয়ে হত্যা করছ! এরপর রাসূল (ﷺ) ছুমামার নিকট লিখেন যে, সে যেন তাদের আপন অবস্থায় ছেড়ে দেয়।সীরাতে ইবনে হিশাম ৩১৭/৪, ফাতহুল বারী ৮৮/৮। ()আল্লামা ইবনে হাজার রহ. উল্লেখ করেন যে, ইবনে মান্দাহ স্বীয় সনদে ছুমামাহ ইবনুল আসালের ইসলাম গ্রহণ, তারপর ইয়ামামার দিকে ফিরে যাওয়া, কুরাইশদের প্রতিহত করা ইত্যাদি দীর্ঘ ঘটনা ও আল্লাহ তা‘আলার বাণী
﴿وَلَقَد أَخَذۡنَٰهُم بِٱلۡعَذَابِ فَمَا ٱسۡتَكَانُواْ لِرَبِّهِمۡ وَمَا يَتَضَرَّعُونَ ﴾[المؤمنون:76]
অর্থ, আর অবশ্যই আমি তাদেরকে আযাব দ্ধারা পাকড়াও করলাম, তবুও তারা তাদের রবের কাছে নত হয়নি এবং বিনীত প্রার্থনাও করে না। সুরা আল-মুমিনুন আয়াত ৭৬। নাযিল হওয়ার ঘটনা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেন: আহলে ইয়ামামাহ যখন মুরতাদ হয়ে যায় তখন ছুমামা মুরতাদ হয়নি। সে ইসলামের উপর অটল অবিচল থাকে।তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে ‘আলা ইবনে হাযরামীর দলভুক্ত হন এবং তাদের সাথে একত্র হয়ে বাহরাইনের অধিবাসীদের যারা মুরতাদ হয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং তাদের হত্যা করেন। ()দেখুন: আল-ইসাবাহ ২০৩/১।

আল্লাহু আকবর! রাসূল (ﷺ) এর হিকমত কতই না মহান ছিল! এবং তিনি কতই না মহত্বের অধিকারী ছিলেন! রাসূল (ﷺ) ব্যবহার ও আখলাক দ্বারা মানুষের অন্তরকে আকৃষ্ট করত। যাদের থেকে ইসলামের আশা করত, তাদের সাথে বিনম্র ব্যবহার করত। বিশেষ করে যারা কোন গোত্রের সরদার, যাদের আওতায় অনেক লোক রয়েছে, তাদের ইসলাম গ্রহণ করার দ্বারা আরও অনেক লোক ইসলাম কবুল করবে, তাদের সাথে তিনি অত্যন্ত সর্তকতার সাথে কাজ চালিয়ে যেতেন।

একজন দা‘ঈর জন্য উচিত হল, সে অপরাধীর ক্ষমা করার বিষয়টি প্রতিশোধ নেয়া হতে বড় করে দেখবে। কারণ, এখানে আমরা দেখতে পাই যে, রাসূল (ﷺ) যখন তার দিকে দয়া ও ক্ষমার হাত প্রসার করল, মুহূর্তের মধ্যে ছুমামা যে জিনিষটিকে ঘৃণা করত, তা তার নিকট সর্বাধিক প্রিয় বস্তুতে পরিণত হল। রাসূল (ﷺ) এর ক্ষমা ছুমামার জীবনে অসাধারণ পরিবর্তন আনল। তিনি শুধু ইসলামই গ্রহণ করেননি, তবে তিনি নিজে ইসলামের উপর আমরণ অটল অবিচল রইলেন এবং ইসলামের একজন দা‘ঈতে পরিণত হলেন। () ফাতহুল বারী ৮৮/৮ শরহে নববী লিল মুসলিম ৮৯/১২।

দুই. যে বেদুঈন লোকটি রাসূল (ﷺ) কে হত্যা করতে চাইছিল, তার সাথে রাসূল (ﷺ) এর আচরণ:
জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ হতে ইমাম বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,
«قال: غزونا مع رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم قِبَلَ نجد، فأدركنا رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم في واد كثير العضاه، فنزل رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم تحت شجرة، فعلق سيفه بغصن من أغصانها، قال: وتفرق الناس في الوادي يستظلون بالشجر، قال: فقال رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم: [إن رجلاً أتاني وأنا نائم، فأخذ السيف فاستيقظت وهو قائم على رأسي، فلم أشعر إلا والسيف صلتاً في يده، فقال لي، من يمنعك مني؟ قال: قلت: اللَّه، ثم قال في الثانية: من يمنعك مني؟ قال: قلت: اللَّه، قال: فشام السيف، فهاهو ذا جالس[، ثم لم يعرض لـه رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم. »
অর্থ, আমরা রাসূল (ﷺ) নাজদের দিকে যুদ্ধ করতে গেলে, রাসূল আমাদের বাগান বিশিষ্ট একটি উপত্যকার সন্ধান করে দেন। সেখানে রাসূল (ﷺ) একটি গাছের নিচে অবতরণ করেন এবং তার তলোয়ারটি গাছের একটি ডালের সাথে ঝুলিয়ে রাখেন। সবাই বিভিন্ন গাছের তলে ছায়া নিতে গিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জাবের (রাঃ) বলেন, রাসূল বর্ণনা দেন যে, এক লোক আমাকে ঘুমের মধ্যে আমার নিকট এসে আমার তলোয়ারটি হাতে নেয়। আমি সাথে সাথে ঘুম থেকে জেগে দেখি লোকটি আমার মাথার উপর দাঁড়ানো। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না! শুধু দেখতে পেলাম যে, আমার তলোয়ারটি তার হাতে ঝুলছে। তারপর সে আমাকে বলে, তোমাকে আমার হাত থেকে কে বাঁচাবে? তিনি বলেন, আমি বললাম, আমাকে আল্লাহ বাঁচাবে। লোকটি দ্বিতীয়বার বলল, তোমাকে আমার হাত থেকে কে রক্ষা করবে? তিনি বলেন, আমি বললাম আল্লাহ!। তারপর তলোয়ারটি তার হাত থেকে পড়ে গেল। আর লোকটি বসা অবস্থায় রয়ে গেল। [লোকটির হাত থেকে তলোয়ারটি পড়ে গেলে রাসূল (ﷺ) ইচ্ছা করলে তলোয়ারটি তুলে নিয়ে তাকে হত্যা করতে পারত। কিন্তু তিনি করেননি] তারপর রাসূল (ﷺ) তাকে কিছুই বললেন না। ()বুখারি ,কিতাবুল জিহাদ ২৯১০ মুসলিম, কিতাবুল ফাজায়েল ৮৪৩ আহমদ ৩১১/৩, আহমদ ৩৬৪/৩, ৩১১/৩।

আল্লাহু আকবর! আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর আখলাক কতই না মহান ও উন্নত। তার অন্তর কত বড় ও প্রশস্থ। একজন লোক তাকে হত্যা করতে চেষ্টা করে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে তার হাত থেকে রক্ষা করার পর, যখন উল্টো আবার রাসূল (ﷺ)কে হত্যা করতে ক্ষমতা দেন; ইচ্ছা করলে তিনি তাকে হত্যা করতে পারেন। কিন্তু না, তিনি তাকে হত্যা না করে তাকে ক্ষমা করে দেন! একেই বলা হয়, খুলুকে আজীম বা মহান চরিত্র। আল্লাহ তা‘আলা এ বিষয়ে কুরআনে করীমে বলেন,
﴿ وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيم ﴾ [القلم:4]
অর্থ, আর নিশ্চয় তুমি মহান চরিত্রের অধিকারী। সুরাতুল কলম, আয়াত: ৪।

রাসূল (ﷺ) এর এ চরিত্রের প্রভাব লোকটির জীবনে বিপ্লবী পরিবর্তন আনে। লোকটি পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করে ইসলামের একজন দা‘ঈ হয়ে যায় এবং তার মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ হেদায়েত প্রাপ্ত হয় এবং ইসলামের সুশীতল ছায়া তলে আশ্রয় নেয়। ()দেখুন: ফাতহুল বারী ৪২৮/৭ শরহে নববী ৪৪/১৫ এখানে ইমাম নববী ও আল্লামা ইবনে হাজার রহ. উল্লেখ করেন যে, লোকটির না গাওরাস ইবনুল হারেস। এমনকি ইমাম বুখারি তার ছহীহতে লোকটির একই নাম উল্লেখ করেন হাদীস নং ৪১৩৬।

তিন. ইয়াহুদীদের একজন বড় জ্ঞানী যায়েদ ইবনে সায়ানার সাথে রাসূল (ﷺ) এর আচরণ:
রাসূল (ﷺ) এর স্বভাব হল, প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতা থাকলে তিনি প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমা করে দিতেন, ক্রোধের সময় তিনি ধৈর্যশীল ও সহনশীল থাকতেন। কেউ অপরাধ করলে তার প্রতি ভালো ব্যবহার করতেন। রাসূল (ﷺ) এর দাওয়াতে সাড়া দেয়া, তার রিস্বলাতে প্রতি ঈমান আনা এবং তার নেতৃত্বে একত্র হওয়ার অন্যতম কারণ হল, রাসূল (ﷺ) এর মহান ও উন্নত চরিত্র। ইয়াহুদীদের বড় আলেম এবং একজন বিশিষ্ট পাদ্রী যায়েদ ইবনে সায়ানার সাথে রাসূল (ﷺ) এর আচরণের একটি ঘটনা: () দেখুন: হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব ৫২৮ ও হিদায়াতুল মুরশিদীন ৩৮৪।
«جاء زيد بن سعنة إلى رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم يطلبه ديناً لـه، فأخذ بمجامع قميصه وردائه وجذبه، وأغلظ لـه القول، ونظر إلى النبي صلى الله عليه وسلم بوجه غليظ وقال: يا محمد، ألا تقضيني حقي، إنكم يا بني عبد المطلب قوم مُطْلٌ، وشدّد لـه في القول، فنظر إليه عمر وعنياه تدوران في رأسه كالفلك المستدير، ثم قال: يا عدو اللَّه، أتقول لرسول اللَّه صلى الله عليه وسلم ما أسمع، وتفعل ما أرى، فوالذي بعثه بالحق لولا ما أحاذر لومه لضربت بسيفي رأسك، ورسول اللَّه صلى الله عليه وسلم ينظر إلى عمر في سكون وتُؤَدَةٍ وتَبَسُّمٍ، ثم قال: [أنا وهو يا عمر كنا أحوج إلى غير هذا منك يا عمر، أن تأمرني بحسن الأداء، وتأمره بحسن التقاضي، اذهب به يا عمر فاقضه حقه، وزده عشرين صاعاً من تمرٍ[، فكان هذا سبباً لإسلامه، فقال: أشهد أن لا إله إلا اللَّه، وأشهد أن محمداً عبده ورسوله. »
অর্থ. যায়েদ ইবনে সায়ানা রাসূল (ﷺ) এর নিকট ঋণ বাবদ তার পাওনা চাইতে আসে। সে এসেই তার জামার কলার ও চাদরের একত্রস্থান টেনে ধরে এবং অত্যন্ত কঠোর ভাষায় বলে। তারপর সে রাসূল (ﷺ) এর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে বলে, হে মুহাম্মদ! তুমি কি আমার পাওনা আদায় করবে না? তোমরা বনী মুত্তালিবরা অবশ্যই টাল-বাহানাকারী সম্প্রদায়! সে এ ছাড়াও আরও কঠিন কথা বলে। ওমর (রাঃ) তার দিক তাকিয়ে দেখল, তার দুই চোখ মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। তারপর সে বলল, হে আল্লাহর দুশমন! তুমি আমার চোখের সামনে রাসূল (ﷺ) কে এসব কথা বলছ! রাসূল (ﷺ) এর সাথে এ ধরনের ব্যবহার করছ ! আমি ঐ আল্লাহর শপথ করে বলছি! যিনি তাকে সত্যের পয়গাম নিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, যদি আমি তার ভ সনাকে ভয় না করতাম, তবে আমি আমার তলোয়ার দিয়ে তোমার মাথাকে উড়িয়ে দিতাম। রাসূল (ﷺ) নীরবে ও মুচকি হেসে ওমরের কথার দিকে লক্ষ্য করেন। তারপর তিনি বলেন, হে ওমর বিষয়টি আমার ও তার ব্যাপার। আমরা তোমার চেয়ে অন্য কিছু আশা করছিলাম। [এ ধরনের আচরণ তোমার থেকে আমরা আশা করিনি] তুমি আমাকে আদেশ করতে পারতে তার পাওনা পরিশোধ করতে, আর তাকে নির্দেশ দিতে পারতে নম্র-ভাবে তার পাওনা আমার নিকট চাইতে। হে ওমর! তুমি তাকে নিয়ে যাও, এবং তার পাওনা তাকে দিয়ে দাও। আর [যেহেতু তুমি তার সাথে ভালো ব্যবহার করনি তার বিনিময়] তাকে তুমি বিশ সা, বেশি দাও। এ ঘটনাটিই ছিল লোকটির ইসলাম গ্রহণের কারণ। তারপর সে বলে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই। মুহাম্মদ (ﷺ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।

এ ঘটনার পূর্বে যায়েদ বলত, আমি শেষ নবীর সব আলামতই মুহাম্মদ (ﷺ) এর চেহারায় দেখতে পাই। কিন্তু দুটি বিষয় আমার অজানা ছিল, যেগুলো আমাকে জানানো হয়নি। এক. তার ধৈর্য তার জাহালাতের উপর প্রাধান্য পায়। দুই. অজ্ঞতা যত বাড়তে থাকে তার ধৈর্যও তত বেশি বাড়তে থাকে।

তিনি এ ঘটনার মাধ্যমে রাসূল (ﷺ) এর পরীক্ষা করেন, তারপর সে যেভাবে বর্ণনা করেন সেভাবেই তাকে পান। ফলে ঈমান আনেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি রাসূল (ﷺ) এর সাথে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং তাবুকের যুদ্ধে শত্রুর মোকাবেলা করতে করতে যখন সামনের দিকে অগ্রসর হন, তখন তিনি শাহাদাত বরণ করেন। () আল ইসাবাহ ফি তামীযিয সাহাবাহ ৫৬৬/১।

রাসূল (ﷺ) এর জীবনীতে এ ধরনের আরও অসংখ্য প্রমাণাদি রয়েছে, যে গুলো প্রমাণ করে তার নবুওয়তের সত্যতা ও যথার্থতা উপর। আর তিনি আল্লাহর দ্বীনের যে দাওয়াত নিয়ে এসেছেন তা হল, পরম সত্য তার মধ্যে মিথ্যার কোন অবকাশ নাই।

চার. গ্রাম্য লোক যে মসজিদে পেশাব করছিল, তার সাথে রাসূল (ﷺ) এর আচরণ:
আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«بينما نحن في المسجد مع رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم إذ جاء أعرابي، فقام يبول في المسجد، فقال أصحاب رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم: مَه مَهْ قال: قال رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم: [لا تزرموه، دعوه[، فتركوه حتى بال، ثم إن رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم دعاه فقال لـه: [إن هذه المساجد لا تصلح لشيء من هذا البول، ولا القذر، إنما هي لذكر اللَّه، والصلاة وقراءة القرآن[، أو كما قال رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم. »
একদা আমরা রাসূল (ﷺ) সাথে মসজিদে বসা ছিলাম। এ অবস্থায় একজন অপরিচিত লোক এসে মসজিদে দাড়িয়ে পেশাব করতে আরম্ভ করে। তখন রাসূলের সাহাবীরা তাকে বলল, থাম, থাম, বর্ণনা কারী বলেন, রাসূল (ﷺ) তাকে বলে, তোমরা তাকে বাধা দিও না। তাকে তার আপন অবস্থায় ছেড়ে দাও। তারপর তারা তাকে আপন অবস্থায় ছেড়ে দিলে সে পেশাব সম্পন্ন করে। তারপর রাসূল (ﷺ) তাকে ডাকল, এবং বলল, এ হল, মসজিদ এখানে পেশাব পায়খানা করা চলে না। এতো শুধু আল্লাহর জিকির, স্বলাত আদায় ও কুরানের তিলাওয়াতের জন্য বানানো হয়েছে। অথবা রাসূল (ﷺ) যেভাবে বলেছেন-

বর্ণনাকারী বলেন,
«فأمر رجلاً من القوم فجاء بدلو من ماء فشنّه عليه»
অর্থ, তারপর রাসূল (ﷺ) এক লোককে আদেশ দিলে সে একটি বালতি করে পানি নিয়ে আসে এবং তা পেশাবের উপর ডেলে দেয়।() মুসলিম কিতাবুত তাহারাহ ২৮৫, বুখারি কিতাবুল ওজু ২১৯।

«وقد ثبت في البخاري وغيره أن هذا الرجل هو الذي قال: اللَّهم ارحمني ومحمداً ولا ترحم معنا أحداً، »
বুখারি ও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত, এ লোকটিই বলে,

«اللَّهم ارحمني ومحمداً ولا ترحم معنا أحداً»
অর্থ, হে আল্লাহ তুমি আমাকে ও মুহাম্মদকে দয়া কর আমাদের সাথে কাউকে দয়া করবে না।

অপর এক বর্ণনায় আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«قام رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم وقمنا معه، فقال أعرابي وهو في الصلاة: اللَّهم ارحمني ومحمداً، ولا ترحم معنا أحداً، فلما سلم النبي صلى الله عليه وسلم قال للأعرابي: [لقد حجرت واسعاً[ يريد رحمة اللَّه».
রাসূল (ﷺ) দাঁড়ালে তার সাথে আমরাও দাড়াই। তখন একজন লোক স্বলাতে বলে, হে আল্লাহ আমাকে এ মুহাম্মদকে দয়া কর, আমাদের সাথে আর কাউকে দয়া করবে না। রাসূল (ﷺ) যখন সালাম ফিরান তখন তিনি গ্রাম্য লোকটিকে বলেন, তুমি আল্লাহর ব্যাপক রহমতকে সংকীর্ণ করে দিলে, অর্থাৎ আল্লাহর রহমত।() বুখারি কিতাবুল আদব ৬০১০, তিরমিযি কিতাবুত তাহারাত ১৪৭, আহমদ ২৪৪/২, আবুদাউদ ৩৯/২।

বুখারি ছাড়া অন্যান্য হাদিসের কিতাবসমূহে এ ধরনের বর্ণনার ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:
যেমন আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«دخل رجل أعرابي المسجد فصلى ركعتين ثم قال: اللَّهم ارحمني ومحمداً، ولا ترحم معنا أحداً! فالتفت إليه رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم فقال: [لقد تحجّرت واسعاً[، ثم لم يلبث أن بال في المسجد، فأسرع الناس إليه فقال لهم رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم: [إنما بعثتم ميسرين، ولم تبعثوا معسرين، أهريقوا عليه دلواً من ماء، أو سجلاً من ما»
একজন গ্রাম্য লোক মসজিদে প্রবেশ করে দুই রাকাত স্বলাত আদায় করে তারপর বলে, হে আল্লাহ তুমি আমাকে এবং মুহাম্মদকে দয়া কর, আমাদের সাথে আর কাউকে দয়া করো না। এ কথা শোনে রাসূল (ﷺ) তার দিকে তাকায় এবং বলে তুমি ব্যাপককে সংকীর্ণ করে দিলে। এ কথা বলতে না বলতে লোকটি মসজিদে পেশাব করে দিল। লোকেরা তার দিকে দৌড়ে আসলে, রাসূল (ﷺ) তাদের বললেন, তোমাদের প্রেরণ করা হয়েছে, সহজ করার জন্য কঠিন করার জন্য নয়। তোমরা তার উপর এক বালতি অথবা এক মশক পানি ডেলে দাও। তিরমিযি ১৪৭, আহমদ ১০৫৪০। ()

তিনি বলেন, লোকটি ইসলাম গ্রহণ করার পর বলেন,
«فقام النبي صلى الله عليه وسلم إليّ بأبي وأمي فلم يسب، ولم يؤنب، ولم يضرب».
অর্থ, রাসূল (ﷺ) আমার দিকে অগ্রসর হল, তার উপর আমার মাতা পিতা কুরবান হোক সে আমাকে একটু ঘালি দেয়নি কোন প্রকার ধমক দেয়নি এবং আমামে একটুও মারেনি।

রাসূল (ﷺ) আল্লাহ তা‘আলার সর্বাধিক জ্ঞানী মাখলুক। তার যাবতীয় কার্যক্রম আচার ব্যবহার হিকমত পূর্ণ ও উন্নত। যে ব্যক্তি তার আখলাক, চরিত্র, দয়া, অনুগ্রহ, ধৈর্য, সহনশীলতা ইত্যাদি সম্পর্কে জানবে তার প্রতি তার ঈমান এ বিশ্বাস আরও বৃদ্ধি পাবে। গ্রাম্য লোকটি এমন কাজই করল, যা শাস্তি যোগ্য ও উপস্থিত লোকদের তোপের মুখে পড়ার মত অপরাধ। কাজটি যে কোন মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলে। এ কারণেই রাসূলের সাহাবীরা দাড়িয়ে গেল, কাজটিকে অপছন্দ করল এবং তাকে ধমক দিল। কিন্তু রাসূল (ﷺ) তাকে পেশাবে বাধা দিতে না করলেন।

এটি ছিল রাসূল (ﷺ) নম্রতা, সহনশীলতা ও দয়াদ্রতার সবোর্চচ বহি:প্রকাশ। রাসূল (ﷺ) অত্যন্ত হিকমতের সাথে গ্রাম্য লোকটির কাজকে পরিবর্তন করে দেন। যখন সে বলে «اللَّهم ارحمني ومحمداً، ولا ترحم معنا أحداً হে আল্লাহ আমাকে ও মুহাম্মদকে দয়া কর আমাদের সাথে আর কাউকে দয়া করো না, তখন রাসূল (ﷺ) তাকে বললেন, [لقد تحجرت واسعاً] তুমি ব্যাপক রহমতকে সংকীর্ণ করে দিলে। রাসূল (ﷺ) এর উদ্দেশ্য এ কথা দ্বারা আল্লাহর রহমত। কারণ, আল্লাহর রহমত সব কিছুকে সামিল করে নেয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿ وَرَحۡمَتِي وَسِعَتۡ كُلَّ شَيۡء ۚ ﴾ আর আমার রহমত সব বস্তুকে পরিব্যাপ্ত করেছে।() সূরা আরাফ আয়াত ১৫৬।

আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় আল্লাহর রহমত ব্যাপক তা সবকিছুকেই সামিল করে নেয়। অথচ লোকটি আল্লাহ তা‘আলার মাখলুকের উপর তার রহমতকে সংকীর্ণ করে দেন। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা যে ব্যক্তি এর বিপরীত অর্থাৎ ব্যাপক রহমত কামনা করছে, কুরআনে কারীমে তার প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَٱلَّذِينَ جَآءُو مِنۢ بَعۡدِهِمۡ يَقُولُونَ رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَا تَجۡعَلۡ فِي قُلُوبِنَا غِلّ ا لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوف رَّحِيمٌ﴾ [الأعراف:156]
অর্থ, যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে: হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন: এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না; হে আমাদের রব, নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু। সুরা আল-হাশর আয়াত ১০

আয়াতে যে ব্যাপক রহমত কামনা করছে তার প্রসংশা করছে। অপর দিকে এ গ্রাম্য লোকটি আয়াতের খেলাপ দোয়া করে। এ কারণে রাসূল (ﷺ) হিকমতের সাথে তাকে বুঝিয়ে দেন। ()ফাতহুল বারী ৪৩৯/১০

আর যখন লোকটি মসজিদে পেশাব করা আরম্ভ করে দেয়, তখন রাসূল (ﷺ) তাকে আপন অবস্থায় ছেড়ে দিতে নির্দেশ দেন। যারা তাকে পেশাব করতে বাধা দিতে সামনে অগ্রসর হচ্ছিল তাদের তিনি বারণ করেন। কারণ, সে তো একটি ফ্যাসাদ আরম্ভ করে দিয়েছে, এখান যদি তাকে বাধা দেয়া হয়, তাহলে তার ক্ষতি আরও বেড়ে যাবে। মসজিদের কিছু অংশ নাপাক হলই, এখন যদি তাকে আরও বাধা দেয়া হয়, আরও দুটি ক্ষতি হতে পারে।

এক. পেশাব আরম্ভ করার পর তার পেশাব করা বন্ধ করে দেয়া হলে, তার ক্ষতি হতে পারে। কারণ, পেশাব বের হওয়ার পর বন্ধ করা স্বাস্থ্য সম্মত নয়।
দুই. অথবা যদি তাকে বাধা দেয়া হয়, তাতে তার শরীরের অন্যান্য অংশ, পরিধেয় কাপড় ও মসজিদ ইত্যাদিতে নাপাক ছড়িয়ে যেতে পারে। তাই রাসূল (ﷺ) বিশেষ কল্যাণের দিক বিবেচনা করে, তাকে আপন অবস্থায় ছেড়ে দেন এবং তার থেকে বিরত থাকেন। আর বিশেষ কল্যাণ হল, বড় দুটি খারাবী অথবা ক্ষতিকে প্রতিহত করতে তুলনা মূলক কম ক্ষতিকে মেনে নেন। () ফাতহুল বারী ৩২৫/১

এ ছিল রাসূল (ﷺ) মহান হিকমত ও উন্নত বুদ্ধিমত্তা। রাসূল (ﷺ) খারাবীর বিপরীতে কল্যাণকর দিক গুলো বিবেচনায় রাখেন। এ ঘটনার মাধ্যমে রাসূল (ﷺ) তার উম্মত ও দা‘ঈদের জন্য জাহেলদের কোন প্রকার ধমক, গালি, কষ্ট ও দুর্ব্যবহার ছাড়া কিভাবে দয়া করবে ও তালীম দেবে তা নির্ধারণ করে দেন। রাসূল (ﷺ) এ ব্যবহার- তার প্রতি দয়া করা, বিনম্র আচরণ-এ গ্রাম্য লোকটির জীবনে বিশাল প্রভাব ফেলে। লোকটি ইসলাম গ্রহণ করার পর বলে, রাসূল (ﷺ) আমার দিক অগ্রসর হন। আমার মাতা-পিতা তার উপর কুরবান হোক তিনি আমাকে কোন প্রকার ঘালি দেননি, আমাকে ধমক দেননি, এবং প্রহার করেননি। লোকটির জীবনে রাসূল (ﷺ) এর এ চরিত্র বিশাল প্রভাব ফেলে। () ফাতহুল বারী ৩২৫/১

পাঁচ. মুয়াবিয়া ইবনে হাকামের সাথে রাসূল (ﷺ) এর আচরণ:
মুয়াবিয়া ইবনে হাকাম আসসুলামী হতে বর্ণিত তিনি বলেন,
«قال: بينما أنا أصلي مع رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم إذ عطس رجل من القوم، فقلت: يرحمك اللَّه! فرماني القوم بأبصارهم، فقلت: واثكل أمياه ما شأنكم تنظرون إليَّ؟ فجعلوا يضربون بأيديهم على أفخاذهم فلما رأيتهم يصمتونني، لكني سكت، فلما صلى رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم فبأبي هو وأمي ما رأيت معلماً قبله ولا بعده أحسن تعليماً منه، فواللَّه ما كهرني ولا ضربني ولا شتمني، قال: [إن هذه الصلاة لا يصلح فيها شيء من كلام الناس، إنما هو التسبيح والتكبير وقراءة القرآن[، أو كما قال رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم. »
অর্থ, একদিন আমরা রাসূল (ﷺ) এর সাথে স্বলাত আদায় করতে ছিলাম, তখন এক লোক স্বলাতে হাছি দিলে আমি বললাম আল্লাহ তোমাকে রহম করুক। এ কথা বলার পর লোকেরা আমাকে তাদের চোখ দ্বারা ইশারা করে চুপ করাতে থাকে। আমি তাদের বললাম, তোমাদের মাতা সন্তান হারা হোক! তোমরা আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছ কেন? তারপর তারা তাদের হাত দ্বারা রানের উপর আঘাত করে আমাকে চুপ করানোর চেষ্টা করে। আমি যখন বুঝতে পারলাম, তারা আমাকে চুপ করাচ্ছে, আমি চুপ হয়ে গেলাম। রাসূল (ﷺ) এর উপর আমার মাতা-পিতা কুরবান হোক ইতিপূর্বে ও পরে কখনোই তার চেয়ে উত্তম কোন শিক্ষক যিনি এত সুন্দর তালীম দিতে পারে, আমি দেখিনি। আল্লাহর শপথ করে বলছি, তিনি আমাকে একটু ধমক দেননি, আমাকে প্রহার করেনি এবং কোন প্রকার গাল মন্দ করেননি। স্বলাত শেষ করার পর, আমাকে বললেন, স্বলাতে কোন প্রকার কথা বলার অবকাশ নাই। স্বলাত হল, তাসবীহ, আল্লাহর জিকির ও কুরআনের তিলাওয়াত।
«قلت: يا رسول اللَّه! إني حديث عهد بجاهلية، وقد جاء اللَّه بالإسلام، وإن منا رجالاً يأتون الكهان، قال: [فلا تأتهم. [ قال: ومنا رجال يتطيرون، قال: [ذاك شيء يجدونه في صدورهم فلا يصدنهم[ ، (قال ابن الصلاح: فلا يصدنكم)، قال: قلت: ومنا رجال يخطون. قال: [كان نبي من الأنبياء يخط، فما وافق خطه فذاك».
আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল! আমি নতুন ইসলাম গ্রহণ করেছি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের ইসলামের মত নেয়ামত দান করেছেন। আমাদের কতক লোক আছে যারা গণকদের কাছে আসে। রাসূল (ﷺ) বললেন, তাদের নিকট তুমি আসবে না। তিনি আরো বলেন, আমাদের কিছু লোক এমন আছে, যারা পাখি উড়িয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করে! রাসূল (ﷺ) বলেন, এটি একটি কুসংস্কার যা তাদের অন্তরে তারা লালন করে, এ সব যেন তোমাকে কোন কাজ থেকে বিরত না রাখে। বললেন, ইবনুস সালাহ তোমাকে যেন এ সব থেকে বিরত না রাখে। বলেন, আমি বললাম আমাদের মধ্যে কতক লোক আছে তারা দাগ টানে! তিনি বলেন, একজন নবী ছিল তিনি দাগ টানতেন, যার দাগ তার দাগের সাতে মিলে সে ভাগ্যবান। তারপর সে বলে,
«وكانت لي جارية ترعى غنماً لي قِبَلَ أحد والجوَّانية فاطلعت ذات يوم فإذا الذئب قد ذهب بشاة من غنمها، وأنا رجل من بني آدم، آسف كما يأسفون، لكني صككتها صكة، فأتيت رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم فعظم ذلك عليَّ، قلت: يا رسول اللَّه! أفلا أعتقها، قال: [ائتني بها[، فأتيته بها، فقال لها: [أين اللَّه؟[ قالت: في السماء، قال: [من أنا؟[ قالت: أنت رسول اللَّه. قال: [أعتقها فإنها مؤمنة».
অর্থ. আমারা একটি বাঁদি ছিল, সে ওহুদ এ জাওয়ানিয়ার দিকে আমার ছাগল চরাত। সে একদিন এসে আমাকে বলল, একটি ছাগল নেকড়ে বাঘ এসে নিয়ে গেছে। আমি একজন আদম সন্তান হিসেবে অন্যান্যদের মত ব্যথিত হই। তারপর আমি তাকে একটি থাপ্পড় দিই। আমি রাসূল (ﷺ) এর দরবারে আসলে বিষয়টি আমার নিকট পীড়াদায়ক মনে হলে আমি বলি হে আল্লাহর রাসূল! তাকে আজাদ করে দিব কি? রাসূল (ﷺ) বললেন, তাকে তুমি আমার নিকট নিয়ে আস। আমি রাসূল (ﷺ) এর নিকট নিয়ে আসলে রাসূল (ﷺ) তাকে জিজ্ঞাসা করে বলে, আল্লাহ কোথায়? সে বলে আল্লাহ আসমানে। তারপর রাসূল (ﷺ) জিজ্ঞাসা করে, আমি কে? সে বলে, তুমি আল্লাহর রাসূল। তখন রাসূল (ﷺ) বললেন, তাকে আজাদ করে দাও! কারণ সে ঈমানদার। মুসলিম কিতাবুল মাসাজেদ ৫৩৭। ()[হাদীসে একটি কথা স্পষ্ট হয় যে আল্লাহ তা‘আলা আসমানে। অনেকেই মনে করে আল্লাহ তা‘আলা সর্বত্র বিরাজমান। তাদের এ ধারণা যে ভ্রান্ত্র তা এ হাদীস ও অন্যান্য আরো কুরআনের আয়াত ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।] রাসূল (ﷺ) এর এ আচরণ উন্নত হিকমত ও মহান চরিত্রেরই বহি:প্রকাশ, যা কেবল তাকেই আল্লাহর পক্ষ হতে দেয়া হয়েছে। এ কারনেই তিনি একজন মহা মানব। মুয়াবিয়ার জীবনে এর একটি প্রভাব পড়ছে। কারণ মানুষ যে তার প্রতি এহসান করে তার দিকে আকৃষ্ট হয়। এ কারণেই মুয়াবিয়া বলে, রাসূল (ﷺ) এর উপর আমার মাতা-পিতা কুরবান ইতিপূর্বে ও পরে কখনোই তার চেয়ে উত্তম কোন শিক্ষক যিনি এত সুন্দর তালীম দিতে পারে আমি দেখিনি। আল্লাহর শপথ করে বলছি, তিনি আমাকে একটু ধমক দেননি, আমাকে প্রহার করেনি এবং কোন প্রকার গাল মন্দ করেননি।

ছয়. তোফাইল ইবনে আমর আদদাউসির সাথে রাসূল (ﷺ) এর ব্যবহার:
রাসূল (ﷺ) তোফাইল ইবনে আমর আদদাউসীর সাথে হিকমত পূর্ণ আচরণ করেন। রাসূল (ﷺ) এর হিজরতের পূর্বে মক্কায় তিনি ইসলাম গ্রহণ করে। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি তার স্ব-জাতীর নিকট ফিরে যান এবং তাদের ইসলামের দিকে দাওয়াত দেন। প্রথমে তিনি তার পরিবারের লোকদের দাওয়াত দিলে তার পিতা ও স্ত্রী ইসলাম গ্রহণ করে। তারপর তিনি তার গোত্রের লোকদের ইসলামের দাওয়াত দিলে তারা তার দাওয়াতে সাড়া দেয়নি এবং তার দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে। তোফাইল রাসূল (ﷺ) এর নিকট এসে অভিযোগ করল, আমর দাউস সম্প্রদায়ের লোকেরা ধ্বংস, তারা কাফের, নাফরমান ও অস্বীকারকারী। আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন,
«جاء الطفيل بن عمرو الدوسي إلى رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم فقال: إن دوساً قد عصت وأبت، فادع اللَّه عليهم، فاستقبل رسول اللَّه القبلة ورفع يديه، فقال الناس: هلكوا. فقال: [اللَّهم اهد دوساً وائت بهم، اللَّهم اهد دوساً وائت بهم».
তোফাইল রাসূল (ﷺ) এর নিকট বলে, নিশ্চয় দাউস সম্প্রদায়ের লোকেরা নাফরমান ও অস্বীকারকারী। আপনি তাদের জন্য বদদোয়া করেন। রাসূল (ﷺ) কেবলামূখী হয়ে দু হাত তোলেন, রাসূল (ﷺ) এর অবস্থা দেখে লোকেরা মন্তব্য করল যে দাউস সম্প্রদায়ের ধ্বংস অনিবার্য। কিন্তু না, রাসূল (ﷺ) বললেন, হে আল্লাহ! তুমি দাউস সম্প্রদায়কে হেদায়েত দাও এবং তাদের তুমি ইসলামের নিয়ে আস। হে আল্লাহ! তুমি দাউস সম্প্রদায়কে হেদায়েত দাও এবং তাদের তুমি ইসলামের ছায়া তলে নিয়ে আস। ()বুখারি কিতাবুল জিহাদ ২৯৩৭, মুসলিম ২৫২৪, আহমদ ৪৪৮।

রাসূল (ﷺ) এ দোয়া প্রমাণ করে রাসূল (ﷺ) আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করাতে কতটা সহনশীল ও ধৈর্যশীল ছিলেন। কারণ, তিনি তাদের জন্য আযাব চাননি এবং যারা দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করছে তাদের জন্য বদদোয়াও করেননি। তবে রাসূল (ﷺ) তাদের জন্য হেদায়েতের দোয়া করেন, আল্লাহ তা‘আলা তা দোয়া কবুল করেন। তার ধৈর্য , সহনশীলতা ও আযাবের জন্য তাড়াহুড়া না করার সুফল তিনি পরবর্তীতে দেখতে পান। তোয়াইল তার সম্প্রদায়ের লোকদের নিকট গিয়ে আবারো যখন তাদের সাথে নম্রতা প্রদর্শন করে তার হাতে অনেক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে। তারপর সে রাসূল (ﷺ) এর সাথে খাইবরে দেখা করে। তখন দাউসের ঊননব্বইটি পরিবার ইসলাম গ্রহণ করে মদিনায় প্রবেশ করে। তারা রাসূল (ﷺ) এর সাথে মদিনায় প্রবেশ করলে রাসূল মুসলিমদের সাথে তাদের জন্য মালে গণিমতের অংশ বণ্টন করেন।
আল্লাহু আকবর! রাসূল (ﷺ) হিকমত কতনা মহান! তার কারণেই ঊননব্বইটি পরিবার ইসলাম গ্রহণ করে।

একটি কথা মনে রাখতে যারা আল্লাহর দিকের দা‘ঈ তাদের কর্তব্য হল দাওয়াতে ধৈর্যধারণ ও সহনশীল হওয়া। আর তা কেবল আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ ও দাওয়াতি ময়দানে রাসূল (ﷺ) এর আদর্শ কি তা জানার মাধ্যমেই সম্ভব।

সাত. একজন যুবক রাসূল (ﷺ) এর নিকট ব্যভিচার করার অনুমতি চাইলে, তার সাথে রাসূল (ﷺ) এর আচরণ:
«عن أبي أمامة قال: إن فتىً شاباً أتى النبي صلى الله عليه وسلم فقال: يا رسول اللَّه، ائذن لي بالزنا، فأقبل القوم عليه فزجروه، وقالوا لـه: مه مه! فقال لـه: [ادنه[، فدنا منه قريباً، قال: [أتحبه لأمك؟[ قال: لا واللَّه، جعلني اللَّه فداءك، قال: [ولا الناس يحبونه لأمهاتهم[. قال: [أفتحبه لابنتك؟[ قال: لا واللَّه يا رسول اللَّه، جعلني اللَّه فداءك. قال: [ولا الناس يحبونه لبناتهم[. قال: [أفتحبه لأختك؟[ قال: لا واللَّه جعلني اللَّه فداءك. قال: [ولا الناس يحبونه لأخواتهم[. قال: [أفتحبه لعمتك؟[ قال: لا واللَّه، جعلني اللَّه فداءك. قال: [ولا الناس يحبونه لعماتهم[. قال: [أفتحبه لخالتك؟[ قال: لا واللَّه جعلني اللَّه فداءك. قال: [ولا الناس يحبونه لخالاتهم[. قال: فوضع يده عليه، وقال: [اللَّهم اغفر ذنبه، وطهر قلبه، وحصّن فرجه[، فلم يكن بعد ذلك الفتى يلتفت إلى شيء. »
অর্থ. আবি উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একজন যুবক রাসূল (ﷺ) এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! তুমি আমাকে জিনা করার অনুমতি দাও। তার কথা শুনে সবাই তাকে ধমক দিতে শুরু করে এবং তাকে থাম থাম! বলতে থাকে। রাসূল (ﷺ) তাকে বলল, তুমি কাছে আস! যখন কাছে আসল রাসূল (ﷺ) তাকে বলল, তুমি তোমার মায়ের সাথে জিনা করতে পছন্দ কর? সে বলল, না আল্লাহর শপথ করে বলছি। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে তোমার জন্য কুরবান করুক। কোন মানুষই তার মায়ের সাথে ব্যভিচার করতে পছন্দ করে না। তারপর রাসূল (ﷺ) তাকে বলল, তুমি তোমার মেয়ের সাথে জিনা করতে পছন্দ কর? সে বলল, না আল্লাহর শপথ করে বলছি। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে তোমার জন্য কুরবান করুক। কোন মানুষই তার মেয়ের সাথে ব্যভিচার করতে পছন্দ করে না। তারপর রাসূল (ﷺ) তাকে বলল, তুমি তোমার ফুফুর সাথে জিনা করতে পছন্দ কর? সে বলল, না আল্লাহর শপথ করে বলছি। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে তোমার জন্য কুরবান করুক! কোন মানুষই তার ফুফুর সাথে ব্যভিচার করতে পছন্দ করে না। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম তাকে বলল, তুমি তোমার খালার সাথে জিনা করতে পছন্দ কর? সে বলল, না আল্লাহর শপথ করে বলছি। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে তোমার জন্য কুরবান করুক। কোন মানুষই তার খালার সাথে ব্যভিচার করতে পছন্দ করে না। তারপর রাসূল (ﷺ) তার হাত তার উপর রাখে এবং বলে, হে আল্লাহ! তুমি তার গুণা মাপ কর, তার অন্তর পরিষ্কার কর এবং লজ্জা স্থানের হেফাজত কর। তারপর থেকে যুবকটি কখনোই এদিক সেদিক তাকায়নি।() আহমদা তার মুসনাদে ২৫৭/২।

লক্ষণীয় বিষয় হল, যারা আল্লাহর দিকে মানুষদের দাওয়াত দেয় তাদের জন্য রাসূল (ﷺ) এর এ আদর্শে রয়েছে উত্তম চরিত্র। তাদের উচিত তারা যেন মানুষের সাথে বিনম্র আচরণ করে তাদের প্রতি দয়ার্দ্র থাকে। বিশেষ করে ইসলামে প্রবেশের জন্য যাদের অনুকূলতার প্রয়োজন হয় অথবা যাদের ঈমানের মজবুতি ও ইসলামের উপর অবিচলতা একান্ত কাম্য হয়।

রাসূল (ﷺ) যেভাবে মানুষের সাথে বাস্তবিক উত্তম নম্র ও ভদ্র ব্যবহার করতেন অনুরূপভাবে তিনি আমাদেরকে সব সময় উত্তম নম্র ও ভদ্র ব্যবহারের জন্য আদেশ দেন। এ বিষয়ে কয়েকটি হাদিস নিম্নে উল্লেখ করা হল,
«فعن عائشة ’ قالت: دخل رهط من اليهود على رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم فقالوا: السامُ عليكم. قالت عائشة: ففهمتها فقلت: وعليكم السامُ واللعنة. قالت: فقال رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم: [مهلاً يا عائشة إن اللَّه يحب الرفق في الأمر كله،[ فقلت: يا رسول اللَّه أولم تسمع ما قالوا؟ قال رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم: [قد قلت: وعليكم».
এক. আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইয়াহুদীদের একটি জামাত রাসূল (ﷺ) এর নিকট প্রবেশ করে বলে, আস্সামু আলাইকুম, আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি তাদের কথা বুঝতে পেরে বলি এবং তোমাদের উপর সাম ও অভিশাপ। তিনি বলেন, তারপর রাসূল (ﷺ) বলেন, হে আয়েশা তুমি থাম! আল্লাহ তা‘আলা প্রতিটি ক্ষেত্রে নম্রতাকে পছন্দ করে। আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল! তারা কি বলছে আপনি শোনেনি? তখন রাসূল (ﷺ) বলেন, তুমি-তো ওয়া আলাইকুম বলছ।() বুখারি ৬০২৪।

তারপর রাসূল (ﷺ) আরও বলেন,
«يا عائشة إن اللَّه رفيق يحب الرفق، ويعطي على الرفق ما لا يُعطي على العُنْف، وما لا يُعطي على ما سواه»
হে আয়েশা! আল্লাহ তা‘আলা রফিক, তিনি প্রতিটি কাজে নম্রতাকে পছন্দ করেন। নমনীয়তার উপর তিনি যা দেন কঠোরতার উপর তিনি তা দেন না এবং তা ছাড়া অন্য কিছুর উপর তিনি তা দেন না। ()মুসলিম ২৫৯৩।

রাসূল (ﷺ) আরও বলেন,
«إن الرفق لا يكون في شيء إلا زانه، ولا يُنْزع من شيء إلا شانه».
যে কোন জিনিষের মধ্যে নমনীয়তা তার সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করে আর যে কোন কাজে নমনীয়তা থাকবে না, তা তাকে ত্রুটিযুক্ত করবে।() (পূর্বের রেফারেন্স ২৫৯৪)

রাসূল (ﷺ) বর্ণনা করেন, أن من حُرِمَ الرفق فقد حرم الخير، যে ব্যক্তি নম্রতা হতে বঞ্চিত, সে যাবতীয় কল্যাণ হতে বঞ্চিত। রাসূল (ﷺ) বলেন,[من يحرم الرفق يحرم الخير] যে ব্যক্তি নম্রতা হতে বঞ্চিত, সে অবশ্যই যাবতীয় কল্যাণ হতে বঞ্চিত।() (পূর্বের রেফারেন্স ২৫৯২) আবু দারদা হতে বর্ণিত রাসূল (ﷺ) বলেন,
«من أٌعطيَ حظه من الرفق فقد أعطي حظه من الخير، ومن حُرِمَ حظه من الرفق فقد حرم حظه من الخير»
যাকে নম্রতা হতে কিছু অংশ দেয়া হয়েছে, তাকে কল্যাণ হতে একটি অংশ দেয়া হয়েছে। আর যাকে নম্রতা হতে বঞ্চিত করা হয়েছে তাকে যাবতীয় কল্যাণের হতে আংশিক বঞ্চিত করা হয়েছে। ()তিরমিযি ২০১৩।

তার থেকে আরও বর্ণিত তিনি বলেন,
«من أعطي حظه من الرفق أعطي حظه من الخير، وليس شيء أثقل في الميزان من الخُلُق الحسن»
যাকে নম্রতা হতে কিছু অংশ দেয়া হয়েছে, তাকে কল্যাণ হতে একটি অংশ দেয়া হয়েছে। উত্তম চরিত্র হতে আর কোন কিছুই কিয়ামতের দিন পাল্লায় এত বেশি ভারি হবে না। ()মুসানাদে আহমদ ৪৫১/৬

«وعن عائشة ’ أن النبي صلى الله عليه وسلم قال لها: [إنه من أعطي حظه من الرفق فقد أعطي حظه من خير الدنيا والآخرة، وصلة الرحم، وحسن الخلق، وحسن الجوار يعمران الديار ويزيدان في الأعمار. »
আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল সা বলেন, যাকে রিফক হতে কিছু অংশ দেয়া হয়ে থাকে, তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণ হতে একটি অংশ দেয়া হয়ে থাকে। আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক, উত্তম চরিত্র, প্রতিবেশীদের সাথে সু-ব্যবহার ইহকালকে সুন্দর করে এবং বয়সকে বাড়িয়ে দেয়। ()আহমদ ১৫৯/৬

রাসূল (ﷺ) যাবতীয় সমস্ত কাজে নম্রতাকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন এবং রাসুল (ﷺ) তার কথা, কাজ ও বর্ণনার দ্বারা এর গুরুত্ব পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরেন, যাতে তার উম্মতগণ তাদের যাবতীয় কাজে নমনীয়তা প্রদর্শন করেন। বিশেষ করে যারা আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করেন, তাদের জন্য মানুষের সাথে দাওয়াতি ময়দানে, যাবতীয় লেনদেন ও কর্মে নমনীয়তা প্রদর্শন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উল্লেখিত হাদিসগুলো নম্রতার ফজিলত বর্ণনা করে এবং নম্রতার গুণে গুণান্বিত হওয়ার প্রতি উৎসাহ দেয়। এ ছাড়াও হাদিসে উত্তম চরিত্রে চরিত্রবান হওয়ার প্রতি বিশেষ উৎসাহ দেয়া হয়। কঠোরতা ও যারা কঠোরতা করে তাদের দুর্নাম করা হয়ে এবং খারাব চরিত্র হতে দূরে থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়।

মনে রাখতে হবে, নম্রতা যাবতীয় কল্যাণ লাভের কারণ। নম্রতা দ্বারা মানুষ তার অভীষ্ট লক্ষে পৌছতে পারে এবং তার উদ্দেশ্য হাসিল করা সম্ভব হয়। আল্লাহ তা‘আলা নম্রতার উপর এত বেশি সাওয়াব দান করেন, যা অন্য কোন নেক আ‘মাল বা নম্রতার বিপরীত কঠোরতা দ্বারা লাভ করা সম্ভব হয় না।

রাসূল (ﷺ) তার উম্মতের উপর কঠোরতা করতে নিষেধ করেন। আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন আমি রাসূল (ﷺ) কে আমার ঘরে বলতে শুনেছি। তিনি বলেন, «اللَّهم من ولي من أمر أمتي شيئاً فشقّ عليهم، فاشقق عليه، ومن ولي من أمر أمتي شيئاً فرفق بهم فارفق به» হে আল্লাহ যদি কোন ব্যক্তি আমার উম্মতের দায়িত্বশীল হয়, তারপর তাদের উপর কঠোরতা করে, তুমিও তার উপর কঠোরতা করবে। আর যে ব্যক্তি আমার উম্মতের উপর দায়িত্বশীল হওয়ার পর তাদের নম্রতা দেখায়। হে আল্লাহ তাদের সাথে তুমি নমনীয় আচরণ কর। ()মুসলিম কিতাবুল জিহাদ ১৮২৮।

রাসূল (ﷺ) যখন কোন সাহাবীকে কোন কাজে বাহিরে পাঠান, তাদের তিনি সহজ করতে নির্দেশ দেন এবং তাদের তিনি কঠোরতা করতে না করেন।

فعن أبي موسى قال: كان رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم: إذا بعث أحداً من أصحابه في بعض أموره قال: «بشِّرُوا ولا تُنفِّرُوا، ويسِّرُوا ولا تُعسِّرُوا»

আবি মুসা আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) যখন কোন ব্যক্তিকে কোন বিষয়ে কোথাও পাঠাতেন তখন তাদের তিনি বলতেন, তোমরা তাদের সু-সংবাদ দাও, তাদের তোমরা দূরে সরাবে না। তোমরা তাদের জন্য সহজ করে দাও তাদের উপর কঠোরতা করো না। ()

وقال صلى الله عليه وسلم لأبي موسى الأشعري ومعاذ حينما بعثهما إلى اليمن: « [يسَّرا ولا تعسِّرا، وبشِّرا ولا تنفِّرا، وتطاوَعَا ولا تختلِفَا. »
রাসূল (ﷺ) আবু মুসা আশয়ারী (রাঃ) ও মুয়ায ইবনে জাবাল (রাঃ) যখন ইয়ামনের দিকে পাঠান তখন তিনি বলেন, তোমরা উভয় সহজ কর কঠিন কর, তোমরা সু-সংবাদ দাও দূরে সরাবে না। তোমরা একমত থাকবে মতবিরোধ করবে না। () মুসলিম কিতাবুল জিহাদ ১৩৫৮/৩, ১৭৩২।

وعن أنس بن مالك قال: قال رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم: « [يسِّرُوا ولا تعسِّرُوا، وبشِّرُوا ولا تنفِّرُوا»
আনাস ইবনে মালেক হতে বর্ণিত রাসূল (ﷺ) বলেন, তোমরা সহজ কর কঠিন করো না তোমরা তাদের সুসংবাদ দাও তাদের দূরে সরাবে না। () বুখারি কিতাবুল ইলম ৬৯ মুসলিম কিতাবুল জিহাদ ১৭৩২।

উল্লেখিত হাদিস সমূহে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) তা উম্মতদের সহজ করতে নির্দেশ এবং এমন কোন নির্দেশ দিতে না করেন, যা তাদেরকে তোমাদের থেকে দূরে সরাবে। রাসূল (ﷺ) উল্লেখিত হাদিসগুলোতে দুটি বিষয় নরম তার বিপরীতে গরম উভয়টি একত্র করে আলোচনা করেন। কারণ একজন মানুষ এক সময় নরম দেখাবে আবার অন্য সময় গরম দেখাবে। কখনো সময় সুসংবাদ দেবে আর কখনো সময় ভয় দেখাবে। রাসূল (ﷺ) উভয় দিকটিকে একত্র করেন। কারণ, তিনি যদি শুধু তোমরা কঠোরতা করো না এ কথা বলতেন অথবা তোমরা সুসংবাদ দাও শুধু এ কথা বলতেন তাহলে মানুষ তার বিপরীত কাজ করা হতে একদম বিরত থাকত। রাসূল (ﷺ) এ সব হাদিসে আল্লাহ তা‘আলার অশেষ রহমত, মহান সাওয়াব, তার নেয়ামত ও ব্যাপক রহমতের প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন। অপর দিকে তিনি ভয় দেখানোর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার আযাব হতে মানুষকে সতর্ক করেন। এখানে যারা নতুন ইসলাম গ্রহণ করেছে তাদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা হয়ে থাকে। কারণ, তাদের প্রতি কোন প্রকার কঠোরতা করা হয়নি। এতে এ কথা স্পষ্ট হয় আরও যে সব বাচ্চারা নিকটে বালেগ হয়েছে বা কোন গুনাহগার নতুন তাওবা করেছে তাদের সাথে নমনীয় দেখানো ভালো। তাদের সাথে কোন প্রকার কঠোরতা দেখানো উচিত নয়। ইসলামের কোন বিধানই এ সাথে নাযিল হয়ে যায়নি বরং সব বিধানই আস্তে আস্তে নাযিল হয়েছে যাতে উম্মতের উপর কঠিন না হয়। বরং উম্মতের জন্য সহজ হয়। কারণ, একজন ব্যক্তি যখন দেখতে পাবে ইসলাম পালন করা সহজ, তখন সে ইসলামে প্রবেশে আগ্রহী হবে। আর যখন দেখতে পাবে ইসলাম পালন করা এতটা সহজ নয় তখন সে ইসলামে প্রবেশ হতে দূরে থাকবে। সুতরাং মনে রাখতে হবে যে কোন তালীম তরবিয়ত ধীরে ধীরে হওয়া চাই। এক সাথে সব কিছু তালিম দেয়া যায় না। এ কারণে রাসূল (ﷺ) তার সাহাবীদের তালিমের ব্যাপারে মাঝে মাঝে বিরতি দিতেন যাতে তারা বিরক্ত না হয়ে যায়।() দেখুন: ফতহুল বারী ১৬৩, ১৬২/১।

রাসূল (ﷺ) তার উম্মতকে সব ভালো কাজের দিকে পথ দেখান আর তাদেরকে সব ধরনের মন্দ ও খারাব কাজ হতে ভয় দেখান ও সতর্ক করেন। আর যারা তার উম্মতের উপর কঠোরতা করে তাদের জন্য তিনি অভিশাপ করেন। আর যারা তার উম্মতের জন্য সহজ করেন এবং নম্রতা প্রদর্শন করেন তাদের জন্য তিনি দোয়া করেন। যেমনটি আয়েশা (রাঃ) এর হাদিসে অতিবাহিত হয়েছে। এ ছিল যারা উম্মতের উপর কঠোরতা আরোপ করে তাদের জন্য কঠিন হুমকি আর যারা উম্মতের জন্য সহজ করে তাদের জন্য চূড়ান্ত উৎসাহ। ()দেখুন: শরহে নববী ২১৩/২

আট. হদ কায়েম করার বিষয়ে সুপারিশ-কারীর সাথে রাসূল (ﷺ) এর আচরণ:
রাসূল (ﷺ) যাবতীয় কাজে ও বিধানের ক্ষেত্রে সমগ্র মানুষের চেয়ে বড় ইন-সাফকারী ছিলেন। এ বিষয়ে যে ঘটনাটি কিয়ামত পর্যন্ত ইসলামের ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, তা হল, মাখজুমি গোত্রের মহিলা যে চুরি করার পর তার বিষয়ে উসামা (রাঃ) সুপারিশ করা সত্ত্বেও রাসূল (ﷺ) তার হাত কেটে দেন। আল্লাহ তা‘আলার বিধান বাস্তবায়নে তিনি কারো কোন সুপারিশ কবুল করেননি।
فعن عائشة ’ أن قريشاً أهمهم شأن المرأة المخزومية التي سرقت في عهد النبي صلى الله عليه وسلم في غزوة الفتح، فقالوا: من يكلم فيها رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم؟ فقالوا: ومن يجترئ عليه إلا أسامة بن زيد، حب رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم فأُتيَ بها رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم فكلمه فيها أسامة بن زيد، فتلون وجه رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم فقال: « [أتشفع في حد من حدود اللَّه؟[ فقال له أسامة: استغفر لي يا رسول اللَّه! فلما كان العشي قام رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم فاختطب فأثنى على اللَّه بما هو أهله، فقال: [أما بعد، أيها الناس: إنما أهلك الذين من قبلكم أنهم كانوا إذا سرق فيهم الشريف تركوه، وإذا سرق فيهم الضعيف أقاموا عليه الحد، وإني والذي نفسي بيده لو أن فاطمة بنت محمد سرقت لقطعت يدها.[ ثم أمر بتلك المرأة التي سرقت فقطعت يدها. »

অর্থ. আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (ﷺ) এর যুগে মক্কা বিজয়ের বছর মাখজুমি গোত্রের একজন মহিলা চুরি করে ধরা পড়লে, তা কুরাইশদের চিন্তার কারণ হয়ে পড়ে। তারা বলাবলি করতে লাগলো যে, তার বিষয়ে কে রাসূল (ﷺ) এর দরবারে সুপারিশ করবে? তখন তারা ঠিক করল, এ বিষয়ে রাসূল (ﷺ) এর সর্বাধিক প্রিয় লোক উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ) ছাড়া আর কেউ সাহস করবে না। তারপর উসামা (রাঃ) রাসূল (ﷺ) এর দরবারে এসে তার বিষয়ে কথা বলে এবং সুপারিশ করে। তার কথা শোনে রাসূল (ﷺ) এর চেহারা লাল হয়ে গেল এবং তিনি বললেন, তুমি আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের বিষয়ে আমার নিকট সুপারিশ করছ! এ কথা শোনে উসামা (রাঃ) বলল, হে আল্লাহর রাসুল আপনি আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তারপর যখন সন্ধ্যা হল, তখন রাসূল (ﷺ) মসজিদের মিম্বারে খুতবা দিতে দাঁড়ালো। প্রথমে তিনি আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এমন কথা দ্বারা আল্লাহর প্রশংসা করল। তারপর তিনি বললেন, তোমরা মনে রাখ! তোমাদের পূর্বের উম্মতদের ধ্বংসের কারণ হল, তাদের মধ্যে যদি কোন সম্ভান্ত লোক চুরি করত, তখন তাকে তারা শাস্তি দিত না, তাকে ক্ষমা করে দিত। আর যখন তাদের মধ্যে কোন দুর্বল লোক চুরি করত, তার উপর তারা আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করত। আর আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, যদি মুহাম্মদের মেয়ে ফাতেমাও চুরি করে, আমি তার হাত কেটে দেব। তারপর তিনি মহিলাটির হাত কাটার নির্দেশ দিলে তার হাত কেটে দেয়া হয়।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, তারপর সে তাওবা করে এবং বিবাহ করে। সে মাঝে মাঝে বিভিন্ন প্রয়োজনে রাসূল (ﷺ) এর নিকট আসলে, আমি তার বিষয়টি রাসূল এর নিকট উঠাইতাম। () কিতাবুল হুদুদ: হাদীস নং ৬৭৮৭ মুসলিম কিতাবুল হুদুদ ১৬৮৮

ইনসাফ হল, জুলুমের পরিপন্থী। আল্লাহ তা‘আলা যাবতীয় কর্মে ইনসাফ করার নির্দেশ দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِذَا قُلۡتُمۡ فَٱعۡدِلُواْ وَلَوۡ كَانَ ذَا قُرۡبَىٰۖ وَبِعَهۡدِ ٱللَّهِ أَوۡفُواْۚ ذَٰلِكُمۡ وَصَّىٰكُم بِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تَذَكَّرُونَ ﴾ [الأنعام:152]
অর্থ, আর যখন তোমরা কথা বলবে, তখন ইনসাফ কর, যদিও সে আত্মীয় হয় এবং আল্লাহর ওয়াদা পূর্ণ কর। এ গুলো তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।()সূরা আনআম আয়াত: ১৫২

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَإِذَا حَكَمۡتُم بَيۡنَ ٱلنَّاسِ أَن تَحۡكُمُواْ بِٱلۡعَدۡلِۚ إِنَّ ٱللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُم بِهِۦٓۗ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ سَمِيعَۢا بَصِير ا ﴾ [النساء:58 ]
অর্থ, আর যখন মানুষের মধ্যে ফয়সালা করবে তখন ন্যায়ভিত্তিক ফয়সালা করবে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে কতইনা সুন্দর উপদেশ দিচ্ছেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। সূরা নি(ﷺ) ৫৮

নি:সন্দেহে একটি কথা বলা যায়, রাসূল (ﷺ) ইনসাফ কায়েমের ক্ষেত্রে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন একজন দা‘ঈ বা যারা আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়াতে বাস্তবায়ন করার সংগ্রাম করে তাদের কর্তব্য হল, তারা রাসূল (ﷺ) এ আদর্শের অনুকরণ করবে। আবু দাউদ ২৪২/২, নাসায়ী ৬৪/৭ বুখারি ২৯২/৩, মুসলিম ৪৫৮/৩ হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব ৫৩৫।

নয়. দান খয়রাত করার ক্ষেত্রে রাসূল (ﷺ) এর আচরণ।
«عن أنس قال: ما سُئل رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم على الإسلام شيئاً إلا أعطاه قال: فجاءَه رجلٌ فأعطاه غنماً بين جبلين فرجع إلى قومه فقال: يا قوم، أسلموا؛ فإن محمداً يعطي عطاءً لا يخشى الفاقة»
আনাস ইবনে মালেক হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) এর নিকট কোন কিছু চাওয়া তিনি তাকে কিছু না দিয়ে কোনদিন ফেরত পাঠায়নি। একদিন তার নিকট একজন লোক এসে কিছু চাইলে তিনি তাকে দুই পাহাড়ের মাঝ থেকে একটি ছাগল দেন। ছাগলটি নিয়ে সে তার সম্প্রদায়ে লোকদের নিকট গিয়ে বলে, হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা তোমরা ইসলাম গ্রহণ কর। কারণ, মুহাম্মদ এত বেশি দান করে সে তার নিজের অভাবকে ভয় করে না। ()মুসলিম কিতাবুল ফাযায়েল ১৮০৬/৪।

লোকটির কথা স্পষ্ট প্রমাণ করে রাসূল (ﷺ) কত যে দানশীল ছিলেন এবং তার হাত কতটা প্রসস্থ ছিল। () বুখারি কিতাবুল আদব ৬০৩৩, মুসলিম কিতাবুল ফাজায়েল ১৮০৬,১৮০৫।

রাসূল (ﷺ) আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই আল্লাহর রাহে দান খয়রাত করেন। আবার কখনো সময় ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য লোকদের তিনি দান খয়রাত করেন। প্রথমে দেখা যায়, একজন লোক পার্থিব উদ্দেশ্যে ইসলাম গ্রহণ করে কিন্তু যখন সে রাসূল (ﷺ) এর সাথে থাকতে থাকে তখন কিছু দিন যেতে না যেতে আল্লাহ তা‘আলা তার অন্তরে ইসলামের মোহাব্বত ও ঈমানের হাকীকত খুলে দেয়। তখন তার নিকট ঈমান ও ইসলাম দুনিয়া ও দুনিয়াতে যা কিছু আছে সব কিছুর চেয়ে বেশি প্রিয় হয়ে যায়। () দেখুন: শরহে নববী ৭২/১৫।

এ ধরনের দৃষ্টান্ত হাদিসে অনেক আছে। যেমন ইমাম মুসলিম তার সহীহতে বর্ণনা করেন,
«أن النبي صلى الله عليه وسلم غزا غزوة الفتح – فتح مكة – ثم خرج صلى الله عليه وسلم بمن معه من المسلمين فاقتتلوا بحنين، فنصر اللَّه دينه والمسلمين، وأعطى رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم صفوان بن أمية مائة من الغنم، ثم مائة، ثم مائة. قال صفوان: واللَّه لقد أعطاني رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم ما أعطاني وإنه لأبغض الناس إليّ، فما برح يعطيني حتى إنه لأحب الناس إليَّ».
রাসূল (ﷺ) মক্কা বিজয়ের তার সাথে যে সব মুসলিম ছিল তাদের নিয়ে হুনাইনের দিকে রওয়ানা করেন। সেখানে যুদ্ধ করার পর আল্লাহ তা‘আলা ইসলাম ও মুসলিমদের বিজয় দান করেন। রাসূল (ﷺ) সাফওয়ান ইবনে উমাইয়াকে একশটি উট দেন।তারপর আরও একশ তারপর আরও একশ। সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া বলে, আল্লাহর শপথ, রাসূল (ﷺ) আমাকে যা দেয়ার দিয়েছেন। তিনি আমার নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তিনি যখন দিতে থাকেন এখন সে আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হন। ()মুসলিম কিতাবুল ফাযায়েল ১৮০৬/৪ হাদীস নং ২৩১৩।

«وقال أنس] : إن كان الرجل ليسلم ما يريد إلا الدنيا، فما يسلم حتى يكون الإسلام أحب إليه من الدنيا وما عليها»
আনাস (রাঃ) বলেন, এমন মানুষ ছিল যারা একমাত্র পার্থিব কোন উদ্দেশ্য নিয়েই ইসলাম গ্রহণ করত। কিন্তু যখন সে ইসলাম গ্রহণ করত তখন ইসলাম তার নিকট দুনিয়া ও দুনিয়াতে যা কিছু আছে তা হতে হতে সর্বাধিক প্রিয় বস্তুতে পরিণত হত। ()পূর্বের রেফারেন্স ১৮০৬,৫৮/২৩১২

রাসূল (ﷺ) যখন কোন দুর্বল ঈমানদার লোক দেখতেন তখন তাকে পার্থিব মালামাল বেশি দান করতেন এবং তিনি বলতেন,
«إني لأعطي الرجل وغيره أحب إليّ منه خشية أن يُكبَّ في النار على وجهه».

আমি যদি কোন লোককে কোন কিছু দিয়ে থাকি তা আমার নিকট অধিক পছন্দনীয় তাকে জাহান্নামে উপর করে নিক্ষেপ করার ছেয়ে। এ কারণেই রাসূল (ﷺ) কুরাইশের অনেক লোককে একশ উট দান করে দিতেন।বুখারি কিতাবুযযাকাত ১৪৭৮, মুসলিম কিতাবুযযাকাত ১০৫৯ () যেমনটি হাদিসে বর্ণিত,

«يعطي رجالاً من قريش مائة من الإبل»
অর্থ. রাসূল (ﷺ) কুরাইশের অনেক লোককে একশ উট দান করে দিতেন।() বুখারি ৩১৪৭

রাসূল (ﷺ) এর হিকমত পূর্ণ আচরণের আরেকটি দৃষ্টান্ত হল, দুই মশক বিশিষ্ট মুশরিক মহিলার সাথে রাসূল (ﷺ) এর আচরণ। কারণ রাসূল (ﷺ) ...... মশক দুটি আগের চেয়ে আরও বেশি পরিপূর্ণ রূপে ফিরে আসে। রাসূল (ﷺ) তার সাথীদের বলেন, তোমরা তার জন্য একত্র কর। তখন তারা তার শুকনা খেজুর আটা ও ছাতু ইত্যাদি যোগাড় করে। অনেক গুলো খানা একত্র করে একটি কাপড়ে রাখে এবং তার উটের উপর তুলে দেয়। তারপর কাপড়টি তার সামনে রেখে তাকে বলেন, তুমি যাও তোমার পরিবার পরিজনকে তোমরা এসব খাওয়াও। আল্লাহর শপথ অচিরেই তুমি জানতে পারবে আমরা তোমার পানি হতে একটুও কমাই নাই। তবে আল্লাহ তা‘আলা আমাদের পান করিয়েছে।

এখানে আরও বর্ণিত যে মহিলাটি তার কওমের দিকে ফিরে এসে বলে, আমি বড় একজন যাদুকরের সাথে সাক্ষাত করছি। তারা বিশ্বাস করে সে একজন নবী। আল্লাহ তা‘আলা এ মহিলার মাধ্যমে কয়েকটি পরিবারকে দ্বীনের দিকে হেদায়েত দেন। সে নিজে ইসলাম গ্রহণ করে এবং তার মাধ্যমে আরও অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করে। ()বুখারিو কিতাবুল মানাকেব ৩৫৭১, মুসলিমو কিতাবুল মাসাজেদ ৬৮২।

 মহিলাটির ইসলাম গ্রহণের কারণ দুটি বিষয়:
এক. রাসূল (ﷺ) ও তার ছাহাবীরা তার মশক নিয়ে যেতে সে দেখ। কিন্তু এ কারণে তার পানি একটুও কমেনি। এটি ছিল নিশ্চিত রাসূল (ﷺ) এর মুযেজা যা তার রিস্বলাতের সত্যতার উপর বিশেষ প্রমাণ।

দুই. রাসূল (ﷺ) এর উদারতা ও দানশীলতা। কারণ, তিনি তার সাহাবীদের আদেশ দেন যাতে তারা তার জন্য অনেক খাদ্য একত্র করে। তারপর তারা যখন খাদ্য একত্র করে তা তাকে মুগ্ধ করে। আর তার কওমের লোকেরা তার হাতে ইসলাম গ্রহণ করে। কারণ মুসলিমরা তার কওমের লোকদের অবস্থার প্রতিও বিশেষ গুরুত্বারোপ করে, যাতে তারা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এটাই শেষ পর্যন্ত তাদের ইসলাম কবুল করার কারণ হয়ে দাড়ায়। ()দেখুন: ফাতহুল বারী ৪৫৬/১।

উপরে যে সব দৃষ্টান্ত আলোচনা করা হল, তা রাসূল (ﷺ) দানশীলতা ও বদান্যতার অথৈই সমুদ্রের একটি ফোটা মাত্র। অন্যথায় রাসূল (ﷺ) দানশীলতা ও বদান্যতার বর্ণনা দিয়ে শেষ করা আমাদের কারো পক্ষে সম্ভব নয়। দা‘ঈদের জন্য রাসূল (ﷺ) এর অনুকরণ, তার আদর্শ ও আখলাক হতে এসব আচরণ গুলো চয়ন করে, তা তারা তাদের যাবতীয় কর্মক্ষেত্রে ও দাওয়াতি ময়দানে কাজে লাগাতে পারে। আল্লাহই আমাদের সাহায্যকারী।

দশ. মুনাফেক সরদার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইর সাথে রাসূল (ﷺ) এর আচরণ:
রাসূল (ﷺ) মদিনায় হিজরতের পর দেখতে পেলেন, মদিনার দুই গোত্র আওস ও খাজরায আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের নেতৃত্বে মতৈক্যে পৌঁছেছে। তার ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোন প্রকার বিভেদ নাই। ইতিপূর্বে তারা উভয় গোত্র আর কারো নেতৃত্বে এ ধরনের মতৈক্যে পৌঁছেছেন তার কোন নজীর নাই। রাসূল (ﷺ) মদিনায় পৌঁছে দেখতে পেলেন যে, তারা একটি সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ। তাদের মধ্যে একটি ঐক্য পরিলক্ষিত। কিন্তু রাসূল (ﷺ) যখন তাদের ইসলামের দাওয়াত দিতে আরম্ভ করেন, তাদের ঐক্যে ফাটল ধরে। তাদের থেকে অনেক লোক ইসলাম গ্রহণ করে। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই যখন দেখতে পেল, তার সম্প্রদায়ের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করছে, তখন তার ক্ষোভ ও ক্রদ্ধতা বেড়ে গেল এবং সে বুঝতে পারল যে, রাসূল (ﷺ) তার কর্তৃত্ব চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং ইসলাম ছাড়া তার আর কোন কিছুই কবুল করছে না, তখন সে নিজেও বাধ্য হয়ে ইসলামে প্রবেশ করে। সে বাহ্যিকভাবে ইসলামে প্রবেশ করলেও কিন্তু অন্তর থেকে সে ইসলামকে পছন্দ করতে পারল না। তার অন্তরে ছিল ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ও হিংসা। ইসলাম থেকে মানুষকে ফেরানো, মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ জিয়ে রাখা ও তাদের বিরুদ্ধে ইয়াহুদীদের সাহায্য করার জন্য সে তার যাবতীয় সব ধরনের চেষ্টাই চালিয়ে যেত। ()দেখুন: সীরাতে ইবনে হিশাম ২১৬/২ আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ ১৫৭/৪।

গোপনে ও লোকচক্ষুর আড়ালে ইসলামের দাওয়াতের বিরুদ্ধে তার চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র রাসূল (ﷺ) ও মুসলিমদের নিকট অতিদ্রুত প্রকাশ পায়। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। রাসূল (ﷺ) তার দুশমনি ও বিরোধিতাকে ক্ষমা ও সহনশীলতার সাথে মোকাবেলা করেন। কারণ, তিনি জানতেন সে ইসলাম প্রকাশ করছে। এ ছাড়াও সে মুনাফেকদের সরদার হওয়ার কারণে তাদের মধ্য হতে তার অনুসারী ছিল অনেক। এ কারণে রাসূল (ﷺ) তার সাথে ভালো ব্যবহার করত এবং সে যত ধরনের কষ্ট দিত তার মোকাবেলা ক্ষমা ও ভালো ব্যবহার দ্বারাই করত। তাকে কোন শাস্তি দিত না। নিচে এ বিষয়ে কয়েকটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হল:

ক. বনী কাইনুকার ইহুদিরা যখন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তখন তাদের বিষয়ে তার সুপারিশ:
বদর যুদ্ধের পর মুসলিমদের একজন নারীকে বাজারে উলঙ্গ করে এবং একজন মুসলিমকে হত্যা করে বনী কাইনুকা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। এ ঘটনা ছিল, মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত অপমানজনক ও লজ্জস্কর। এ কারণে এর প্রতিশোধ নেয়ার কোন বিকল্প মুসলিমদের হাতে ছিল না। হিজরতের বিশ মাসের মাথায় রাসূল (ﷺ) শাওয়াল মাসের ১৫ তারিখে এ ঘটনার বদলা নিতে তাদের উপর আক্রমণ করার জন্য বের হন। তিনি প্রথমে তাদেরকে ঘেরাও করে তাদের কিল্লার মধ্যে পনের দিন পর্যন্ত অবরুদ্ধ করে রাখেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লাম তাদের অত্যন্ত শক্তভাবে ঘেরাও করে রাখে। তাদের বাহিরের সাথে যাবতীয় যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এভাবে চলতে থাকলে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করে। তারপর তারা রাসূল (ﷺ) এর সিদ্ধান্ত মেনে নিতে সম্মত হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লামের নির্দেশে তাদের সবাইকে হাত বাধা হয়। তারা সাতশজন যোদ্ধা ছিল, আল্লাহ তা‘আলা যখন মুসলিমদের তাদের উপর ক্ষমতা দেয়, তখন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই রাসূল (ﷺ) এর দরবারে এসে বলে, হে মুহাম্মদ! তুমি আমার গোলামদের ব্যাপারে দয়া কর। তার কথা শোনে রাসূল (ﷺ) চুপ করে থাকেন। সে আবারো বলে হে মুহাম্মদ! তুমি আমার গোলামদের ব্যাপারে দয়া কর। রাসূল (ﷺ) তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তারপর সে তার হাতকে রাসূল (ﷺ) এর জামার আস্তিনে প্রবেশ করে দিয়ে বলে, আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি তোমাকে ততক্ষণ পর্যন্ত ছাড়বো না যতক্ষণ না তুমি চারশত সশস্র যোদ্ধা ও তিনশত নিরশ্র যোদ্ধাদের প্রতি দয়া না করবে। তারা আমাকে লাল চামড়া ও কালো চামড়ার লোকদের থেকে দীর্ঘদিন রক্ষা করেছে। আর তুমি তাদের এক প্রহরেই হত্যা করে ফেলবে তা হয় না। আল্লাহর কসম করে বলছি আমি এমন এক লোক যে সীমান্ত হতে আক্রমণ করাকে ভয় করছি। তারপর রাসূল (ﷺ) তাদের ক্ষমা করে দেন। তাদের নির্দেশ দেন তারা যেন মদিনা হতে বের হয়ে যায় এবং মদিনার আশপাশে কোথাও অবস্থান না করে। তারপর তারা সিরিয়াতে চলে যায়। রাসূল (ﷺ) তাদের থেকে মালামাল রেখে দেন। তারপর তাদের গণিমতকে রাসূল (ﷺ) পাঁচ ভাগ করেন। ()দেখুন: যাদুল মায়াদ ১৯০, ১২৬/৩।

খ. ওহুদের যুদ্ধের দিন রাসূল (ﷺ) এর সাথে তার আচরণ:
ওহুদের যুদ্ধ ছিল মুসলিমদের জন্য একটি বাচা মরার লড়াই। তাই রাসূল (ﷺ) এ যুদ্ধকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন। রাসূল (ﷺ) নিজে এ যুদ্ধ করার তেমন কোন আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু সাহাবীদের আগ্রহের কারণে তিনি এ যুদ্ধ করতে এক রকম বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, কমবখত মুনাফেক আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল এ যুদ্ধে সীমাহীন গাদ্দারী করে। রাসূল (ﷺ) এর সাথে সে তার দলবল নিয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। কিন্তু যখন সে ওহুদ ও মদিনার নিকটে পৌঁছে তখন সে এক তৃতীয়াংশ সৈন্য নিয়ে কেটে পড়ে এবং মদিনায় ফিরে আসে। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম তাদের পিছু নেয় এবং তাদের লজ্জা দেয়, তাদের পুনরায় যুদ্ধে শরীক হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে, সে বলে, তোমরা আস! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ কর, অথবা দুশমনদের প্রতিহত কর। তার কথার উত্তরে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই বলে, আমরা যদি জানতাম, তোমরা এখানে যুদ্ধ করবে, তাহলে আমরা তোমাদের সাথে এখানে আসতাম না। এ বলে সে চলে যায় এবং মুসলিমদের গালি দেয়।(দেখুন : যাদুল মায়াদ ১৯৪/৩, সীরাতে ইবনে হিশাম ৮/৩, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ ৫১/৪) এত বড় অপরাধ সত্ত্বেও রাসূল (ﷺ) তাকে কোন শাস্তি দেয়নি।

গ. রাসূল (ﷺ) কে দাওয়াতী কাজ হতে বিরত রাখার প্রচেষ্টা:
রাসূল (ﷺ) সাআদ ইবনে উবাদাহ এর নিকট যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলে পথে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইর ও তার কওমের লোকদের সাথে দেখা হয়। তাদের দেখে রাসূল (ﷺ) নেমে তাদের সালাম দেয়, তাদের নিকট কিছু সময় অবস্থান করে তাদেরকে কুরআনের তিলাওয়াত শোনান। তাদের আল্লাহর দিকে ডাকেন, আল্লাহর স্মরণ করিয়ে দেন, আযাব হতে সতর্ক করেন, জান্নাতের সু-সংবাদ দেন এবং জাহান্নামের ভয় দেখান। রাসূল (ﷺ) তার কথা শেষ করার পর আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তাকে বলে, আমরা তোমার কথা পছন্দ করি না। যদি তুমি যা বলছ, তা সত্য হয়, তাহলে তুমি ঘরে বসে থাক, যে তোমার কাছে আসবে, তাকে তুমি শোনাও আর যে আসবে না তাকে তুমি শাস্তি দিতে যেও না। তুমি এমন লোকদের মজলিসে যাবে না, যারা তোমার কথাকে অপছন্দ করে। রাসূল (ﷺ) তাকে কিছুই বলেনি, কোন প্রকার শাস্তি না দিয়ে ক্ষমা করে দেন। () দেখুন: সীরাতে ইবনে হিশাম ২১৯, ২১৮/২।

ঘ. বনী নাজিরদের স্বীয় ভূমিতে বহাল থাকতে উদ্বুদ্ধকরণ:
বনী নাজির যখন রাসূল (ﷺ) কে হত্যার পরিকল্পনা করে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, তখন রাসূল (ﷺ) মুহাম্মদ ইবনে মাসলামাকে তাদের নিকট এ নির্দেশ দিয়ে পাঠান, তারা যেন এ শহর থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু মুনাফেকরা বিশেষ করে তাদের সরদার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই রাসূল (ﷺ) এর নির্দেশের বিরোধিতা করে তাদের নির্দেশ দেন যে, তারা যেন বের না হয়। তারা বলে আমরা তোমাদের ছাড়বো না, যদি তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে আমরা তোমাদের হয়ে তাদের সাথে যুদ্ধ করব, আর যদি তোমাদের বের করে দেয়, তাহলে আমরাও তোমাদের সাথে বের হয়ে যাব। তাদের কথা শোনে ইয়াহুদীদের সাহস বেড়ে গেল, তারা রাসূল (ﷺ) নির্দেশকে অমান্য করল। তারপর রাসূল (ﷺ) তাদের ঘেরাও করে ফেলে। রাসূল (ﷺ) তাদের ঘেরাও করে ফেললে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করে দেয়। তারপর তারা আত্মসমর্পণ করলে রাসূল (ﷺ) তাদের দেশান্তর করে এবং খাইবরে গিয়ে তারা আশ্রয় নেয়। ()সীরাতে ইবনে হিশাম ১৯২/৩, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ ৭৫/৪, যাদুল মায়াদ ১২৭/৩।

এবারও রাসূল (ﷺ) আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে ছেড়ে দেয় এবং তাকে কোন প্রকার শাস্তি দেয়নি।

ঙ. রাসূল (ﷺ) ও তার সাথে যারা ইসলাম গ্রহণ করছে, তাদের সাথে মুরাইসী’ এর যুদ্ধে গাদ্দারী ও তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র:
এ যুদ্ধে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল কয়েকটি নির্লজ্জ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, যে গুলো তার শাস্তি ও হত্যাকে ওয়াজিব করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাসূল (ﷺ) এ কমবখত মুনাফিকটিকে কোন প্রকার শাস্তি দেননি বা হত্যা করেননি।
এক. মুনাফেকরা এ যুদ্ধে ইফকের ঘটনা আবিষ্কার করে এবং তারাই এর পিছনে পড়ে। তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে, সে হল, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল।দেখুন : ইফকের ঘটনা। বুখারি কিতাবুল মাগাযি পরিচ্ছেদ: হাদীসূল ইফক ৪১৪১। কিতাবুত তাফসীর সুরা নূর: আল্লাহর বানী- وَلَوْلا إِذْ سَمِعْتُمُوهُ قُلْتُم مَّا يَكُونُ لَنَا أَن نَّتَكَلَّمَ بِهَذَا سُبْحَانَكَ هَذَا بُهْتَانٌ عَظِيمٌ হাদীস নং ৪৫২/২, মুসলিম কিতাবুত তাওবাহ ২১২৯/৪

দুই. এ যুদ্ধে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল বলেছিল,
﴿لَئِن رَّجَعۡنَآ إِلَى ٱلۡمَدِينَةِ لَيُخۡرِجَنَّ ٱلۡأَعَزُّ مِنۡهَا ٱلۡأَذَلَّۚ وَلِلَّهِ ٱلۡعِزَّةُ وَلِرَسُولِهِۦ وَلِلۡمُؤۡمِنِينَ وَلَٰكِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ لَا يَعۡلَمُونَ ﴾المنافقون:8
অর্থ, যদি আমরা মদীনায় ফিরে যাই, তাহলে অবশ্যই সেখান থেকে প্রবলরা দুর্বলদেরকে বহিষ্কার করবে। কিন্তু সকল মর্যাদাতো আল্লাহর, তার রাসূলের ও মুমিনদের। কিন্তু মুনাফেকরা তা জানে না।সুরাতুল মুনাফিকুন আয়াত: ৮, আরো দেখুন: বুখারি কিতাবুত তাফসীর আল্লাহ তা‘আলার বাণি- سَوَاءٌ عَلَيْهِمْ أَسْتَغْفَرْتَ لَهُمْ أَمْ لَمْ تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ لَن يَغْفِرَ اللَّهُ لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ لا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ ৪৯০৫, মুসলিম কিতাবল বির ওয়াস সিলাহ পরিচ্ছেদ: তোমার ভাই যালেম ও মজলুমকে সাহায্য করা বিষয় ১৯৯৮/৪ সীরাতে ইবনে হিশাম ৩৩৪/৩।

তিন. আল্লাহর দুশমন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই বলেছিল, তোমরা তাদের জন্য তোমাদের ধন সম্পদ হতে খরচ করো না। আল্লাহ তায়াল তার বর্ণনা দিতে গিয়ে কুরআনে করীমে এরশাদ করেন,
﴿هُمُ ٱلَّذِينَ يَقُولُونَ لَا تُنفِقُواْ عَلَىٰ مَنۡ عِندَ رَسُولِ ٱللَّهِ حَتَّىٰ يَنفَضُّواْۗ وَلِلَّهِ خَزَآئِنُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَلَٰكِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ لَا يَفۡقَهُونَ ﴾[المنافقون:7]
অর্থ, তারাই বলে, যারা আল্লাহর রাসূলের কাছে আছে তোমরা তাদের জন্য খরছ করো না, যতক্ষণ না তারা সরে যায়। আর আসমানসমূহ ও জমিনের ধন-ভাণ্ডার তো আল্লাহরই, কিন্তু মুনাফিকরা তা বুঝে না।সুরা আল-মুনাফিকুন আয়াত ৭।

ফিতনার আগুন নিবানো ও আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইর খারাবী হতে আত্ম-রক্ষার জন্য রাসূল (ﷺ) এর হিকমত এ কৌশল স্পষ্ট। তিনি আল্লাহর অনুগ্রহ, তারপর ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে তার সকল ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করেন। তার নির্যাতন অন্যায় অনাচারের কোন রকম প্রতিবাদ না করে, তাকে ক্ষমা ও তার প্রতি উদারতা দেখানোর মাধ্যমে তিনি সব কিছু সমাধান করেন। কারণ, সে মুখে ইসলাম প্রকাশ করত, তার সাথে যদি কোন সংঘর্ষে যাওয়া হতো, ইসলামের দাওয়াত বাধা গ্রস্ত হবে এ আশংকায় ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) যখন রাসূল (ﷺ) কে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি অনুমতি দেন আমি তাকে হত্যা করে ফেলি, তখন তিনি বলেন,
«دعه حتى لا يتحدث الناس أن محمداً يقتل أصحابه»
অর্থ, তাকে তার আপন অবস্থার উপর ছেড়ে দাও। কারণ, লোকেরা বলবে মুহাম্মদ তার সাথীদের হত্যা করা আরম্ভ করছে। (বুখারি কিতাবুত-তাফসীর সূরা আল-মুনাফিকুন পরিচ্ছেদ: আল্লাহ তা‘আলার বাণি- ﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا يَسْتَغْفِرْ لَكُمْ رَسُولُ اللَّهِ﴾ ৪৯০৫, মুসালিম কিতাব: মুনাফিকদের বর্ণনা ও তাদের বিধান ৬৩/২৫৮৪।)যদি রাসূল (ﷺ) তাকে হত্যা করত, তাহলে তা মানুষের জন্য ইসলামে প্রবেশের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করত। কারণ, তারা জানে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল একজন মুসলিম। তারা ভাবতো মুসলিমরা মুসলিমদের হত্যা করছে।
এ সব ঘটনা দ্বারা রাসূল (ﷺ) এর বিভিন্ন ফিতনা-ফাসাদের উপর ধৈর্য ধারণ করার কারণটি স্পষ্ট হয়। তিনি যখন দেখতে পেতেন এ ফিতনার প্রতিবাদ করতে গেলে আরও বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে, তখন তিনি ধৈর্য ধারণ করতেন। ফিতনার প্রতিবাদ করতে যেতেন না। ওমর (রাঃ) যখন মুনাফিক সরদারকে হত্যা করতে চাইলেন রাসূল (ﷺ) অনুমতি দেননি। ওমর (রাঃ) পরবর্তী এর হিকমত বুঝতে পারেন। এ কারণেই তিনি বলেন,
قد واللَّه علمت، لأمر رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم أعظم بركة من أمري»
অর্থ, আল্লাহর শপথ করে বলছি, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর আদেশ ও সিদ্ধান্ত আমার মতামত এ সিদ্ধান্ত হতে অধিক বরকতপূর্ণ। আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১৮৫/২, শরহে নববী ১৩৯/১৬, হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব ৩৩৬।

দা‘ঈদের জন্য উচিত হল, তারা তাদের দাওয়াতি ময়দানে রাসূল (ﷺ) এর সুন্নতের অনুকরণ করবে। রাসূল (ﷺ) যেভাবে হিকমতের পথ অবলম্বন করেছেন, তারাও তা আবিষ্কার করবে।

وآخر دعوانا أن الحمد الله رب العالمين، وصلى الله وسلم وبارك على نبينا محمد وعلى آله وأصحابه ومن تبعهم بإحسان إلى يوم الدين.

Copyright by abdr rob

No comments:

Post a Comment