Monday 17 April 2017

এক দশকে যেভাবে তুরস্ককে বদলে দিলেন এরদোগান

সিএনএনের বিশ্লেষণ

এক দশকে যেভাবে তুরস্ককে বদলে দিলেন এরদোগান

Copy by Md Abdur Rob

বিস্ময়কর এক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তুরস্কের হাল ধরেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান। অতি অল্প সময়ের মধ্য দেশটি অর্থনৈতিকভাবে বেশ উন্নতি লাভ করেছে। দারিদ্র্য অবস্থা থেকে লাখ লাখ মানুষকে বের করে আনা হয়েছে।

যদিও দেশটি ধারাবাহিকভাবে মারাত্মক
সন্ত্রাসী হামলার শিকার হচ্ছে। এছাড়াও গত বছর একটি সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালানো হয় কিন্তু এরদোগানের তড়িৎ তৎপরতায় তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। যদিও এই কারণে নাগরিক স্বাধীনতার ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে।

এক দশক আগে তুরস্কের অবস্থা যেরূপ ছিল ২০১৭ সালে পুরোপুরি  ভিন্ন একটি দেশ। রবিবার তুর্কি জনগণ একটি নতুন সংবিধানের জন্য গণভোটে ভোট দেবেন। এটি প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে অভূতপূর্ব ক্ষমতার অধিকারী করতে পারে, যা তার অবস্থানকে অনেক বছরের জন্য সংহত করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এতে ‘হ্যাঁ’ জয়ী হলে সংসদীয় প্রজাতন্ত্র থেকে দেশটি প্রেসিডেন্টশিয়াল শাসন ব্যবস্থায় স্থানান্তরিত হবে। কিন্তু এই ভোট এরদোগান ও দেশটিতে তার পদচিহ্নের জন্য এক চরম অগ্নি পরীক্ষা।
আর্টিকেল-১৮ সংশোধনীর সাংবিধানিক সংস্কার প্যাকেজ অনুয়ায়ী, তিনটি বিধানিক সংস্থার কর্তৃত্ব কার্যকরভাবে একটি কার্যনির্বাহী শাখায় ন্যস্ত থাকবে এবং প্রেসিডেন্ট হবেন এই কার্যনির্বাহী শাখার প্রধান।

সংসদের অনুমোদন ছাড়াই প্রেসিডেন্ট মন্ত্রী ও বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষমতা পাবেন। রাষ্ট্রীয় বাজেট তৈরি এবং সংসদ ভেঙে দেয়ার ক্ষমতাও প্রেসিডেন্টের হাতে থাকবে।

বর্তমানে প্রেসিডেন্টের ভূমিকা মূলত আনুষ্ঠানিক বলে মনে করা হয় কিন্তু এরদোগান ইতোমধ্যেই এই ঐতিহ্য ভঙ্গ করেছেন এবং নিজেকে তুরস্কের নেতৃত্বের কাণ্ডারি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন
লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্সের সমসাময়িক তুর্কি স্টাডিজের প্রধান এসরা ওজিউরেক বলছেন, তুরস্কের জনগণ যদি ‘হ্যাঁ’ ভোট দেয়, তাহলে দেশটি সমস্ত ‘চেক এবং ব্যালেন্স’ থেকে পরিত্রাণ পাবে; যা সরকারকে একটি লাইনে আটকে রেখেছে।

তিনি বলেন, ‘সংসদ সম্পূর্ণরূপে অকার্যকর হবে।এতে কোন প্রধানমন্ত্রী থাকবে না। সকল ক্ষমতা এরদোগানের হাতে থাকবে।’
এরদাগান মূলত গত ১৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে তুরস্ককে শাসন করেছেন। তিনি ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতায় আসেন এবং ২০১৪ সালে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকনে।

ওজিউরেক বলেন, ‘স্পষ্টভাবে এরদোগানের কিছু সহজাত দক্ষতা সম্পন্ন দিক রয়েছে। যারা তাকে ভালোবাসে বলতে পারেন তারা তাদের প্রাণের চেয়েও তাকে বেশি ভালবাসেন। আবার যারা তাকে ঘৃণা করে, তারা প্রচণ্ডভাবে তাকে ঘৃণা করেন।’

এরদোগানের যুক্তি প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি তুরস্ককে স্থায়িত্ব এবং আত্মবিশ্বাসী করবে।

এরদোগান সাম্প্রতি একটি সমাবেশে বিশাল জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘এই ঐতিহাসিক সংস্কারে আসুন আমরা সবাই একত্রিত হই এবং ঐক্য, সংহতি ও সততার সঙ্গে একটি শক্তিশালী, নেতৃস্থানীয় এবং সমৃদ্ধ তুরস্কের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করি।’
এরদোগান ও তার সিনিয়র মন্ত্রীরা বলছেন, সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার তৎপরতা মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী সরকার।

ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর কি ঘটেছে?
২০১৬ সালের ১৬ জুলাই একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে একটি বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটে; যা জনজীবনের প্রতিটি স্তরে পৌঁছায়।

তুর্কি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের মতে, ওই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় ২৪৯ জন নিহত হয়েছেন। যদিও অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল এরদোগান।

এরদোগানকে সমর্থন করছেন কারা?
এরদোগানের বেশিরভাগ বিশ্বস্ত সমর্থক তুরস্কের ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির। এসব মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকদের জীবন দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়েছে।

বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালে এরদোগান যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখন ব্যক্তির গড় আয় ৩,৮০০ ডলারে বৃদ্ধি পায় এবং ২০০৭ সালে এটি দাড়ায় ১০,০০০ ডলারে। এর মানে হল ওই সময় দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ২৩ শতাংশ থেকে ২ শতাংশেরও নিচে নেমে আসে।
কার্নেগী ইউরোপের একজন ভিজিটিং স্কলার মার্ক পিরিনি বলেন, ‘তুরস্কে এখন মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনধারা অনেকটাই বদলে গেছে। আপনি যদি দুই বাচ্চাসহ ৩০ বছর বয়সী একটি দম্পতিকে আজ থেকে ১০ বছর আগের অন্য একটি দম্পতির সঙ্গে তাদের তুলনা করেন, তাহলে পার্থক্যটা পরিষ্কার বুঝা যাবে। আজ তারা একটি ভিন্নধারা জীবন-যাপন করছে।’

মার্ক পিরিনি ২০০৬ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তুরস্কে ইইউ’র রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

পিরিনি জানান, এরদাগান যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তার সরকার তার পূর্বসুরীদের কাছ থেকে একগুচ্ছ সংস্কার পদ্ধতি গ্রহণ করেন এবং দেশটির অবকাঠামো এবং সেবার মান বৃদ্ধির জন্য একসঙ্গে কাজ করেন।

এছাড়াও, সরকার মধ্যম শ্রেণির জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করে।

তিনি বলেন, ‘আজকের একজন মধ্যবিত্ত দম্পতিরও অন্তত একটি অ্যাপার্টমেন্ট আছে। ক্রেডিটের সঙ্গে অবশ্যই তাদের একটি গাড়ি আছে। তারা কেনাকাটা করতে শপিং সেন্টারে যান এবং তারা ভ্রমণেও বের হন। তারা নিজস্ব এয়ারলাইন ব্যবহার করতে পারেন; যা ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল না।’

কোথায় যাচ্ছে তুরস্ক?
পশ্চিমা ও পূর্বের ইসলামিক সংস্কৃতির মধ্যে একটি সেতু হিসাবে দেশটির ভূমিকা পরিবর্তিত হচ্ছে তা অনেকটাই স্পষ্ট।

আধুনিক তুরস্কের ভিত্তি নির্মিত হয়েছিল রাজনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষতার মাধ্যমে। কিন্তু গত দশকে ইসলামের প্রভাব তুর্কি রাজনৈতিক ডিসকোর্স এবং নীতিতে অনেকটা অলক্ষিতভাবেই প্রবেশ করেছে।
এবং দেশটি এখন পশ্চিমা সংস্কৃতি থেকে অনেকটাই দূরে চলে গেছে বলে অনেকে মনে করছেন।

১৯৮৭ সালে তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য পদের জন্য আবেদন করে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ২০০৫ সালে আলোচনা শুরু হয় এবং তারপর থেকে এই আলোচনা বারবার বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।

উদ্বাস্তুসহ বিভিন্ন বিষয়ে তুর্কি কর্মকর্তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি তাদের তীব্র ক্রোধ প্রকাশ করেছেন এবং বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের বিষয়ে তাদের খুব বেশি আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
এরদোগান ইতোমধ্যে বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, প্রয়োজনে তার দেশ মৃত্যুদণ্ডকে ফিরিয়ে আনতে পারে। যা তাৎক্ষণিকভাবে সদস্যপদের জন্য দেশটি অযোগ্য বলে ঘোষিত হতে পারে।

যদি তুর্কি জনগণ রবিবারের গণভোটে ‘হ্যাঁ’র পক্ষে রায়, তবে দেশটি পরিবর্তনের অন্য এক দশকে চলে যাবে।

সুত্রঃ আরটিএনএন

No comments:

Post a Comment