Friday 4 November 2016

সুরা আল জুমআ(নামকরণ, শানে নুযূল, পটভূমি ও বিষয়বস্তু)

আল জুমআ(নামকরণ, শানে নুযূল, পটভূমি ও বিষয়বস্তু)

নামকরণ

৯ নং আয়াতের () আয়াতাংশ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে । এ সূরার মধ্যে যদিও জুম’আর নামাযের আহকাম বা বিধি -বিধানও বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু জুম’আ সামগ্রিকভাবে এর বিষয়বস্তুর শিরোনাম নয় । বরং অন্যান্য সূরার নামের মত এটিও এ সূরার প্রতিকী বা পরিচায়মূলক নাম ।

নাযিল হওয়ার সময়-কাল

প্রথম রুকূ’র আয়াতসমূহ ৭ হিজরীতে সম্ভবত
খায়বার বিজয়ের সময় অথবা তার নিকটবর্তী সময়ে নাযিল হয়েছে । বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসায়ী, এবং ইবনে জারীর হযরত আবু হুরাইরা বর্ণিত একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন যে, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লামের খেদমতে বসে থাকা অবস্থায় এ আয়াতটি নাযিল হয় । হযরত আবু হুরাইরা সম্পর্কে এ বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, তিনি হুদায়বিয়ার সন্ধির পরে এবং খায়বার বিজয়ের পূর্বে ঈমান এনেছিলেন । ইবনে হিশামের বর্ণনা অনুসারে ৭ হিজরীর মুহাররাম মাসে আর ইবনে সা’দের বর্ণনা অনুসারে জমাদিউল উলা মাসে খায়বার বিজিত হয়েছিল । অতএব যুক্তির দাবী হলো, ইহুদীদের এই সর্বশেষ দুর্গটি বিজিত হওয়ার পর আল্লাহ তা’আলা তাদের সম্বোধন করে এ আয়াতগুলো নাযিল করে থাকবেন কিংবা খায়বারের পরিণাম দেখে উত্তর হিজাযের সমস্ত ইহুদী জনপদ যখন ইসলামী রাষ্ট্রের অনুগত হয়ে গিয়েছিল তখন হয়তো এ আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিল ।

দ্বিতীয় রুকূ’র আয়াতগুলো হিজরাতের পরে অল্পদিনের মধ্যে নাযিল হয়েছিল । কেননা নবী(সা) মদীনা পৌছার পর পঞ্চাম দিনেই জুম’আর নামায কায়েম করেছিলেন । এই রুকূ’র শেষ আয়াতটিতে যে ঘটনার প্রতি ইংগিত দেয়া হয়েছে তা স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে যে, আয়াতটি জুম’আর নামায আদায় করার ব্যবস্থা হওয়ার পর এমন এক সময়ে নাযিল হয়ে থাকবে যখন মানুষ দীনী উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠীত সমাবেশের আদব-কায়দা ও নিয়ম-কানুন সম্পর্কে তখনও পুরো প্রশিক্ষণ লাভ করেনি ।

বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য

ওপরে আমরা একথা বলেছি যে, এ সূরার দুটি রুকূ’ দুটি ভিন্ন সময়ে নাযিল হয়েছে । অতএব এর বিষয়বস্তু যেমন আলাদা তেমনি যাদের সম্বোধন করে নাযিল করা হয়েছে সে লোকজনও আলাদা । তবে এ দুটি রুকূর আয়াতসমূহের মধ্যে এক প্রকার সাদৃশ্য আছে এবং এ জন্য তা একই সূরাতে সন্নিবেশিত হয়েছে । সাদৃশ্য কি তা বুঝার আগে রুকূ’ দুটির বিষয়বস্তু আলাদাভাবে আমাদের বুঝে নেয়া উচিত । ইসলামী আন্দোলনের পথ রোধ করার জন্য বিগত ছয় বছরে ইহুদীরা যেসব প্রচেষ্টা চালিয়েছে তা ব্যর্থতায় পর্যবসতি হয়েছে এমনি এক সময় প্রথম রুকূ’র আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিল । প্রথমত মদীনায় তাদের তিন তিনটি শক্তিশালী গোত্র রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লামকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছিল । তারা এর ফল দেখতে পেল এই যে, একটি গোত্র সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেল এবং অপর দুটি গোত্রকে দেশান্তরিত হতে হলো । অতপর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তারা আরবের বহুসংখ্যক গোত্রকে মদীনার ওপর আক্রমণের জন্য নিয়ে আসল কিন্তু আহযাব যুদ্ধে তারা সবাই চপেটাঘাত খেল । এরপর তাদের সবচেয়ে বড় দুর্গ বা আখড়া রয়ে গিয়েছিল খায়বারে । মদীনা ত্যাগকারী ইহুদীদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যাও সেখানে সমবেত হয়েছিল । এসব আয়াত নাযিল হওয়ার সময় সেটিও অস্বাভাবিক রকমের কোন সংঘর্ষ ছাড়াই বিজিত হয় এবং মুসমানদের ভূমি কর্ষণকারী হিসেবে থাকতে খোদ ইহুদীরাই আবেদন জানায় । সর্বশেষ এই পরাজয়ের পর আরবে ইহুদীদের শক্তি সম্পুর্ণ রূপে ধ্বংস হয়ে যায় । ওয়াদিউল কুরা, ফাদাক, তায়ামা, তাবুক সব একের পর এক আত্মসমর্পণ করতে থাকে । ইসলামের অস্তিত্ব বরদাশত করা তো দূরের কথা তার নাম শুনতেও যারা পছন্দ করত না, আরবের সেইসব ইহুদীই শেষ পর্যন্ত সেই ইসলামের প্রজায় পরিণত হয় । এই পরিবেশ পরিস্থিতিতে আল্লাহ তা’আলা এই সূরার মধ্যে আরো একবার তাদেরকে সম্বোধন করলেন । তাদের উদ্দেশ্যে কুরআন মজীদে উল্লেখিত এটাই সম্ভবত সর্বশেষ বক্তব্য । এতে তাদের উদ্দেশ্য করে তিনটি কথা বলা হয়েছেঃ
একঃ তোমরা এ রসূলকে মানতে অস্বীকার করছো এই কারণে যে, তিনি এমন এক কওমের মধ্যে প্রেরিত হয়েছেন যাদেরকে অবজ্ঞা ভরে তোমরা ‘উম্মী’ বলে থাক । তোমাদের ভ্রান্ত ধারণা এই যে, রসূলকে অবশ্যই তোমাদের নিজেদের কওমের মধ্যে থেকে হতে হবে । তোমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে ছিলে যে, তোমাদের কওমের বাইরে যে ব্যক্তিই রিসালাতের দাবী করবে সে অবশ্যই মিথ্যাবাদী । কারণ এই পদমর্যাদা তোমাদের বংশের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে এবং ‘উম্মী’ দের মধ্যে কখনো কোন রসূল আসতে পারেন না । কিন্তু আল্লাহ তা’আলা সেই উম্মীদের মধ্যেই একজন রসূল সৃষ্টি করেছেন । তোমাদের চোখের সামনেই যিনি তাঁর কিতাব শুনাচ্ছেন, মানুষকে পরিশুদ্ধ করেছেন এবং সেই মানুষকে হিদায়াত দান করেছেন তোমরা নিজেরাও যাদের গোমরাহীর অবস্থা জান । এটা আল্লাহর করুণা ও মেহেরবানী , তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন । তাঁর করুণা ও মেহেরবানীর ওপর তোমাদের কোন ইজারাদারী নেই যে, তোমারা যাকে তা দেয়াতে চাও তাকেই তিনি দিবেন আর তোমরা যাকে বঞ্চিত করতে চাও, তাকে তিনি বঞ্চিত করবেন ।
দুইঃ তোমাদের তাওরাতের বাহক বানানো হয়েছিল । কিন্তু তোমরা এর গুরুদায়িত্ব উপলদ্ধিও করোনি, পালনও করোনি । তোমাদের অবস্থা সেই গাধার মত যার পিঠে বই পুস্তকের বোঝা চাপানো আছে কিন্তু সে কি বহন করে নিয়ে যাচ্ছে তা জানে না । তোমাদের অবস্থা বরং ঐ গাধার চেয়েও নিকৃষ্ট । গাধার তো কোন প্রকার-বুদ্ধি -বিবেক নেই, কিন্তু তোমাদের বুদ্ধি-বিবেক আছে । তাছাড়া , তোমরা আল্লাহর কিতাবের বাহক হওয়ার গুরুদায়িত্ব শুধু এড়িয়েই চলছো না, জেনে বুঝে আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলা থেকেও বিরত থাকছো না । এসব সত্ত্বেও তোমাদের ধারণা এই যে, তোমরা আল্লাহর অতি প্রিয় এবং রিসালাতের নিয়ামত চিরদিনের জন্য তোমাদের নামে লিখে দেয়া হয়েছে । তোমরা যেন মনে করে নিয়েছ, তোমরা আল্লাহর বাণীর হক আদায় করো আর না করো কোন অবস্থায়ই আল্লাহ তা’আলা তোমাদের ছাড়া আর কাউকে তাঁর বাণীর বাহক বানাবেন না ।
তিন সত্যিই যদি তোমরা আল্লাহর প্রিয়পাত্র হতে এবং এ বিশ্বাসও তোমাদের থাকতো যে , তাঁর কাছে তোমাদের জন্য অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার স্থান সংরক্ষিত আছে তাহলে মৃত্যুর এমন ভীতি তোমাদের মধ্যে থাকতো না যে, অপমান ও লাঞ্ছনার জীবন গ্রহণীয় কিন্তু কোন অবস্থায়ই মৃত্যু গ্রহণীয় নয় । আর মৃত্যুর এই ভয়ের কারণেই তো বিগত কয়েক বছরে তোমরা পরাজয়ের পর পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছো । তোমাদের এই অবস্থা -ই প্রমাণ করে যে, তোমাদের অপকর্মসমূহ সম্পর্কে তোমরা নিজেরাই অবহিত । তোমাদের বিবেক ভাল করেই জানে যে, এসব অপকর্ম নিয়ে যদি মারা যাও তাহলে পৃথিবীতে যতটা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হচ্ছো আল্লাহর কাছে তার চেয়ে অধিক লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে ।
এ হচ্ছে প্রথম রুকূ’র বিষয়বস্তু । দ্বিতীয় রুকূ’টি এর কয়েক বছর আগে নাযিল হয়েছিল । দ্বিতীয় রকূ’র আয়াতগুলো এ সূরার অন্তরভুক্ত করার কারণ হলো, আল্লাহ তা’আলা ইহুদীদের ‘সাবত’ বা শনিবারের পরিবর্তে মুসলমানদের ‘জুম’আ’ দান করেছেন । তাই তিনি মুসলমানদের সাবধান করে দিতে চান যে, ইহুদীরা, ‘সাবতে’র সাথে যে আচরণ করেছে তারা যেন জুম’আর সাথে সেই আচরণ না করে । একদিন ঠিক জুম’আর নামাযের সময় একটি বাণিজ্য কাফেলা আসলে তাদের ঢোল ও বাদ্যের শব্দ শুনে বারজন ছাড়া উপস্থিত সবাই মসজিদে নববী থেকে বেরিয়ে দৌড়িয়ে কাফেলার কাছে গিয়ে হাজির হয় । অথচ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন খোতবা দিচ্ছিলেন । তাই নির্দেশ দেয়া হয় যে, জুম’আর আযান হওয়ার পর সব রকম কেনাবেচা এবং অন্য সব রকম ব্যস্ততা হারাম । ঈমানদারদের কাজ হলো , এ সময় সব কাজ বন্ধ রেখে আল্লাহর যিকিরের দিকে ধাবিত হবে । তবে নামায শেষ হওয়ার পর নিজেদের কারবার চালানোর জন্য পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার অধিকার অবশ্যই তাদের আছে । জুম’আর হুকুম আহকাম সম্পর্কিত এ রুকূটিতে একটি স্বতন্ত্র সূরাও বানান যেত কিংবা অন্য কোন সূরার অন্তরভুক্ত ও করা যেতে পারত । কিন্তু তা না করে এখানে যেসব আয়াতে ইহুদীদেরকে তাদের মর্মান্তিক পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে বিশেষভাবে সেই সব আয়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে । আমাদের বিবেচনায় এর অন্তরনিহিত উদ্দেশ্য তাই যা আমরা ওপরে বর্ণনা করেছি ।
my website
abdurrob 1996 picture

No comments:

Post a Comment